চাকরি

কর্মসপ্তাহে নতুন বিপ্লব: চার দিন কাজের পর তিন দিনের ছুটি কি স্বপ্ন, নাকি বাস্তবতা?

  প্রতিনিধি ২১ অগাস্ট ২০২৫ , ১২:০৮ পিএম প্রিন্ট সংস্করণ

কর্মসপ্তাহে নতুন বিপ্লব: চার দিন কাজের পর তিন দিনের ছুটি কি স্বপ্ন, নাকি বাস্তবতা?

আপনি কি এমন একটি কর্মজীবনের কথা ভাবতে পারেন, যেখানে সপ্তাহে মাত্র চার দিন কাজ করে বাকি তিন দিন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য অথবা সখের পেছনে ব্যয় করা যায়? এটি কোনো অলীক কল্পনা নয়, বরং বর্তমান বিশ্বে কর্মক্ষেত্রের একটি নতুন বাস্তবতা। সম্প্রতি নেচার হিউম্যান বিহেভিয়ার জার্নাল-এ প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, চার দিনের কর্মসপ্তাহ মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এই পরিবর্তন শুধু কর্মীদের জীবনযাত্রার মানই বাড়ায়নি, বরং কোম্পানির উৎপাদনশীলতাও বাড়িয়েছে।

 

বিশ্বজুড়ে চার দিনের কর্মসপ্তাহের ঢেউ

 

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আয়ারল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ডের ১৪১টি প্রতিষ্ঠানের ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, চার দিনের কর্মসপ্তাহ চালু হওয়ার পর কর্মীদের ক্লান্তি কমেছে, কাজের প্রতি সন্তুষ্টি বেড়েছে এবং তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। গবেষণার প্রধান ওয়েন ফ্যান বলেন, “আমরা দেখেছি, কর্মীদের সুস্থতা যেমন বেড়েছে, তেমনি কোম্পানিগুলোও উৎপাদনশীলতা ও আয়ের ক্ষেত্রে উন্নতি দেখেছে।” এই পাইলট প্রকল্প শেষে ৯০ শতাংশ কোম্পানিই চার দিনের কর্মসপ্তাহ চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এর আগে এক গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত কাজের সংস্কৃতি মস্তিষ্কের গঠনে প্রভাব ফেলতে পারে। চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করাকে প্রায়শই সম্মানের চোখে দেখা হয়। চীনের ‘৯৯৬’ সংস্কৃতি (সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত, সপ্তাহে ছয় দিন কাজ) এর একটি বড় উদাহরণ। অন্যদিকে, জাপানে অতিরিক্ত কাজের কারণে মৃত্যুর জন্য একটি আলাদা শব্দ আছে, ‘কারোশি’। জাপানিজ শ্রমবাজার বিশেষজ্ঞ হিরোশি ওনো বলেন, জাপানে কাজ শুধু একটি চাকরি নয়, বরং একটি সামাজিক রীতি।

তবে এই প্রথাগত ধারণার বাইরে গিয়ে বিশ্বজুড়ে অনেক দেশ এবং কোম্পানি চার দিনের কর্মসপ্তাহ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। আইসল্যান্ডের প্রায় ৯০ শতাংশ কর্মীর এখন সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা কমিয়ে নেওয়ার অধিকার আছে। দক্ষিণ কোরিয়া ২০২৫ সাল থেকে ৬৭টি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষামূলকভাবে সাড়ে চার দিনের কর্মসপ্তাহ চালু করতে যাচ্ছে। জার্মানির ৪৫টি প্রতিষ্ঠানও গত বছর থেকে চার দিনের কর্মসপ্তাহ শুরু করেছে।

 

উৎপাদনশীলতার নতুন সংজ্ঞা

 

চার দিনের কর্মসপ্তাহ মানে কিন্তু পাঁচ দিনের কাজকে চার দিনে ঠেলে দেওয়া নয়। ‘ফোর ডে উইক গ্লোবাল’ সংস্থার সিইও ক্যারেন লো বলেন, মূল বিষয় হলো অপ্রয়োজনীয় কাজ বাদ দেওয়া। যেমন, অপ্রয়োজনীয় মিটিংয়ের বদলে ফোনকল বা মেসেজ ব্যবহার করা। ২০১৯ সালে মাইক্রোসফট জাপান চার দিনের কর্মসপ্তাহ চালু করার পর দেখা যায়, তাদের উৎপাদনশীলতা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিল। এটি প্রমাণ করে যে কম সময়ে কাজ করলে উৎপাদনশীলতা কমে যায়—এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল।

দক্ষিণ আফ্রিকার স্টেলেনবশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং সেন্টারের পরিচালক চার্ল ডেভিডসও এই সাফল্যের কথা তুলে ধরেছেন। তার সেন্টারে চার দিনের কর্মসপ্তাহ চালু করার পর কর্মীদের অনুপস্থিতির হার ৫১ দিন থেকে কমে মাত্র ৪ দিনে নেমে আসে। তিনি বলেন, “কর্মীদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা বাড়ায় তারা কাজে আরও বেশি মনোযোগী হয়েছেন।” এর ফলে শিক্ষার্থীদের দেওয়া সেবার মানও অনেক উন্নত হয়েছে।

 

পরিবর্তনের চালিকাশক্তি: নতুন প্রজন্ম

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি হলো তরুণ প্রজন্ম। ২০২৫ সালের এক বৈশ্বিক জরিপে দেখা গেছে, প্রথমবারের মতো বেতন নয়, বরং কাজ ও জীবনের ভারসাম্যকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। চীনের ‘লাইং ফ্ল্যাট’ আন্দোলন (অতিরিক্ত কাজের সংস্কৃতি প্রত্যাখ্যান), ‘কোয়ায়েট কুইটিং’ (শুধু দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করা) এবং ‘গ্রেট রেজিগনেশন’ (মহামারির পর গণপদত্যাগ)-এর মতো আন্দোলনগুলো প্রমাণ করে, এই সংস্কৃতি পরিবর্তনের দাবি এখন অনেক শক্তিশালী।

অধ্যাপক ওয়েন ফ্যান মনে করেন, কাজের উদ্দেশ্য ও জীবনের কাছে তরুণদের প্রত্যাশা ভিন্ন। তারা কাজের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সুস্থতা, সখ ও পারিবারিক জীবনকে গুরুত্ব দিচ্ছে। জাপানেও ৩০ শতাংশ পুরুষ এখন পিতৃত্বকালীন ছুটি নিচ্ছেন, যা আগে প্রায় ছিলই না। এটি প্রমাণ করে যে মানুষের কাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে এবং তারা নিজেদের সুস্থতাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

ক্যারেন লো-এর বিশ্বাস, এই পরিবর্তনের গতি বাড়ছে। কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের জীবনযাত্রা ও কাজের ধরন নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। এখন চার দিনের কর্মসপ্তাহের এই ধারণাটি একটি বৈশ্বিক আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রের প্রচলিত নিয়মকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দিতে পারে।