প্রতিনিধি ২৪ অগাস্ট ২০২৫ , ১:৪০ পিএম প্রিন্ট সংস্করণ
দীর্ঘ ৩৩ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। আগামী ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচনে শুধু সাধারণ শিক্ষার্থীরাই নয়, বরং দম্পতি ও শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে জয় করা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরাও নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষায় নেমেছেন। এবারের জাকসু নির্বাচন তাই কেবল একটি ছাত্র সংসদ নির্বাচন নয়, বরং এক ব্যতিক্রমী লড়াইয়ের মঞ্চ, যেখানে স্বপ্ন ও প্রত্যয় মিলেমিশে একাকার।
দেশের ছাত্র রাজনীতিতে দথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের মতোই এবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে এক দম্পতি প্রার্থী হয়েছেন। তারা হলেন গণিত বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলাম ও ফার্মেসি বিভাগের ৫০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নিগার সুলতানা। ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল থেকে তরিকুল কার্যকরী সদস্য পদে এবং নিগার সহ-সমাজসেবা ও মানবসেবা উন্নয়ন সম্পাদক (ছাত্রী) পদে লড়ছেন।
তরিকুল ইসলাম জানান, তারা দুজনই ছাত্র শিবিরের প্যানেল থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি নিজে ছাত্র শিবিরের সদস্য হলেও তার স্ত্রী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। তিনি আরও বলেন, “আমরা নির্বাচিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে যাব এবং সবার সম্মিলিত স্বার্থই হবে আমাদের কাজের মূল চালিকা শক্তি।” এই দম্পতির একসঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাত্র রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
জাকসু নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত দিক হলো বেশ কিছু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ। তারা নিজেদের শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে শক্তিতে রূপ দিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন। বাংলা বিভাগের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী মো. সজীব চৌধুরী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল সংসদে ভিপি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তিনি তারুণ্যের কণ্ঠস্বর হতে চান এবং মাদকমুক্ত হল, শিক্ষার্থীদের অধিকার ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার করেছেন। সজীব বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত, এবং ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন।
একই বিভাগের আরেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী আইরিন সুলতানা আঁখি কেন্দ্রীয় সংসদে সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তার মূল লক্ষ্য হলো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল বই, অডিও এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাব দূর করা। এছাড়া, শহীদ সালাম বরকত হল ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আলিফ শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও প্রার্থী হয়েছেন এবং গণতন্ত্র ও শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে জাকসুকে দেখেন।
ইতিহাস বিভাগের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী মহসীন আলীও ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ থেকে কার্যকরী সদস্য পদে লড়ছেন। তিনি ‘ব্রাইট ফিউচার ফর ফিজিক্যালি ডিজএবল সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা এবং বিশ্বাস করেন, নেতৃত্বে আসার মাধ্যমে তারা শুধু নিজেদের নয়, বরং পুরো শিক্ষার্থী সমাজের অধিকার আদায়ের লড়াইকে এগিয়ে নিতে পারবেন।
এবারের জাকসু নির্বাচনে আরেকটি চমক হলো এক বিদেশি শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ। নেপালের ৪৮তম ব্যাচের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী একজন, যিনি কেন্দ্রীয় সংসদের সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে সবার দোয়া চেয়ে লিখেছেন, “একজনমাত্র বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় সংসদে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পেয়ে আমি অভিভূত এবং সকলের সেবা করার জন্য সামনের যাত্রায় সকলের দোয়াপ্রার্থী।”
এই ব্যতিক্রমী প্রার্থীরা প্রমাণ করেছেন, দৃঢ় মনোবল থাকলে কোনো বাধাই সামনে এগোতে বাধা দিতে পারে না। তাদের এই লড়াই কেবল নির্বাচন জেতার নয়, বরং সমাজের সব শ্রেণির মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক সাহসী পদক্ষেপ। জাকসু নির্বাচন তাই এবার একটি ইতিহাস হয়ে থাকছে, যেখানে বৈচিত্র্যই হয়েছে মূল শক্তি।