প্রতিনিধি ২৬ অগাস্ট ২০২৫ , ৯:৩৭ এএম প্রিন্ট সংস্করণ
পাকিস্তানের বর্ষা মৌসুম মানেই বন্যার তীব্র স্রোতে জীবন ও সম্পদহানির এক মর্মান্তিক চিত্র। প্রতি বছর এই একই দৃশ্য পুনরাবৃত্তি হতে থাকে, যেখানে প্রকৃতির ভয়াবহতা এবং মানুষের অসহায়তা একাকার হয়ে যায়। সম্প্রতি খাইবার পাখতুনখাওয়ার সোয়াবি জেলায় হঠাৎ বন্যার স্রোতে দুটি শিশু মাটির নিচে চাপা পড়ে মারা গেল। তাদের নিথর দেহ কাঁধে তুলে নিয়ে গ্রামবাসীদের চোখে জল ছিল না, বরং ছিল সরকারের প্রতি তীব্র ক্ষোভ। তাদের একটাই প্রশ্ন, “সরকার কেন আমাদের আগেভাগে সতর্ক করল না?”
এই প্রশ্নটি কেবল সেই গ্রামের নয়, এটি পুরো পাকিস্তানের মানুষের প্রশ্ন। আরিফ খান নামের এক স্থানীয় ব্যক্তি জানান, বন্যার সময় উদ্ধার কাজের জন্য প্রয়োজনীয় খননযন্ত্র পৌঁছাতে পারেনি প্লাবিত রাস্তায় আটকে। ফলে সারা দিন গ্রামবাসীরাই খালি হাতে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে লাশ উদ্ধার করেছে। এমন অসহায় পরিস্থিতি পাকিস্তানে নতুন কিছু নয়। এই বছরের জুন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ জন বন্যায় প্রাণ হারিয়েছেন, যা ২০২২ সালের প্রায় ১,৭০০ জনের মৃত্যুর শোকাবহ স্মৃতির পুনরাবৃত্তি। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২২ সালের বন্যায় দেশটির ১৪.৯ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
তাহলে প্রশ্ন হলো, কেন এই বিপর্যয় থেকে পাকিস্তান বারবার শিখতে পারছে না? বিশেষজ্ঞরা এর পেছনে একাধিক কারণ তুলে ধরেছেন। ভৌগোলিকভাবে পাকিস্তান জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক শিকার। তীব্র বৃষ্টিপাত, অসহনীয় তাপমাত্রা, খরা এবং হিমবাহ গলে সৃষ্ট হ্রদের ঝুঁকি দেশটিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। অথচ বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে পাকিস্তানের অবদান এক শতাংশেরও কম। তাই অনেকেই এটিকে “আন্তর্জাতিক পাপের মাশুল” হিসেবে দেখছেন। উন্নত দেশগুলোর পরিবেশ দূষণের ফলাফল ভোগ করতে হচ্ছে পাকিস্তানকে।
এই জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় পাকিস্তানের সামনে অন্যতম বড় বাধা হলো বাজেট সংকোচন। চলতি অর্থবছরে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানো হলেও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কমিয়ে আনা হয়েছে মাত্র ৯৭ লাখ ডলারে। সাবেক জলবায়ু মন্ত্রী শেরি রহমান এর কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, নিজেদের স্থিতিশীলতায় বিনিয়োগ না করলে আন্তর্জাতিক সহায়তাও পাওয়া যাবে না।
সরকারের পক্ষ থেকে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও, সেগুলো কার্যকর হচ্ছে না। পাকিস্তান আবহাওয়া দপ্তর নতুন রাডার ও সতর্কতা ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সতর্কবার্তা মানুষের কাছে পৌঁছায় না। নদী-তীরবর্তী এলাকা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলস্বরূপ, প্রতি বছর ঘরবাড়ি ভেঙে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটছে।
পাকিস্তানের রাজধানী করাচির চিত্রও একই রকম হতাশাজনক। দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং নর্দমা দখল করার কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই শহরটি ডুবে যায়। জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এই মৌসুমে প্রায় ৩০ শতাংশ মৃত্যু হয়েছে ঘর ধসে পড়ার কারণে।
সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সহায়তা চাইছে এবং কিছু অভিযোজন পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও তীব্র আর্থিক সংকটের কারণে এই পরিকল্পনাগুলো কার্যকর হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট মোকাবিলায় টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ, নিরাপদ বাসস্থান এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি।
তবে বাস্তবতা হলো—অর্থের অভাব, আইন না মানা এবং দুর্বল শাসন ব্যবস্থার কারণে পাকিস্তান বারবার একই দুর্যোগে পড়ছে। এই বছরের বর্ষা মৌসুম এখনো শেষ হয়নি, নতুন করে বৃষ্টির সতর্কতা জারি হয়েছে। গ্রামীণ অঞ্চলের অসহায় মানুষেরা জানেন না, কবে শেষ হবে তাদের এই দুর্ভোগ। তাদের নীরব কান্না এবং চাপা ক্ষোভই হয়তো পাকিস্তানের জলবায়ু সংকটের সবচেয়ে বড় নীরব প্রমাণ।