প্রতিনিধি ২৬ অগাস্ট ২০২৫ , ৯:৫৩ এএম প্রিন্ট সংস্করণ
গত কয়েক মাস ধরে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ পুনরায় বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে একটি নতুন অস্থিরতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫১ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা মে মাসের তুলনায় প্রায় ২ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা বেশি। এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থার অভাবকেই স্পষ্ট করে তুলছে।
ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থের এই বৃদ্ধিকে অর্থনীতিবিদরা ‘মানুষের হাতে নগদ বৃদ্ধি’ হিসেবে দেখছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতের দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাট মানুষের মধ্যে ব্যাপক অনাস্থা তৈরি করেছে। এর ফলস্বরূপ, অনেক গ্রাহক ব্যাংক থেকে তাদের অর্থ তুলে নিয়ে ঘরে রাখা শুরু করেছেন, যা দেশের ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট সৃষ্টি করেছে। এমনকি ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করেও এই সংকট মোকাবিলা করতে পারেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, মে মাসে মানুষের হাতে নগদ ছিল ২ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা, যা এপ্রিল মাস থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এপ্রিল মাসে এই পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৬ কোটি ৯ লাখ টাকা। চলতি বছরের শুরুতে এই প্রবণতা কিছুটা মিশ্র ছিল। জানুয়ারিতে নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ২৩১ কোটি টাকা, যা ফেব্রুয়ারিতে কমে ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকায় নেমে আসে। তবে মার্চ মাসে তা আবার বেড়ে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এরপরে এপ্রিলে আবার হ্রাস এবং মে-জুন মাসে পুনরায় বৃদ্ধি।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, “ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকার পরিমাণ ওঠা-নামা করা একটি নিয়মিত ঘটনা। মূল্যস্ফীতির চাপ এবং ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অতিরিক্ত খরচ নগদ টাকা হাতে রাখার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, দুর্বল আর্থিক ভিত্তির ব্যাংকগুলোর গ্রাহকরাও আস্থাহীনতার কারণে নগদ অর্থ হাতে রাখছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “ব্যাংক খাতে চলমান অস্থিরতার কারণেই মানুষ নগদ অর্থ নিজেদের কাছে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।” তার মতে, এই প্রবণতা কমাতে হলে সবার আগে গ্রাহকদের হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খানও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের দৈনন্দিন খরচ মেটাতেও নগদ টাকা তোলা হচ্ছে।” তিনি আরও যোগ করেন, সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদের আস্থাহীনতাও এর একটি বড় কারণ। এসব কারণে বাজারে সামগ্রিক মুদ্রা সরবরাহও বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত বছরের আগস্টে সরকারের পালাবদলের পর সেপ্টেম্বর থেকে মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তবে চলতি বছরের মে ও জুন মাসে এর পরিমাণ পুনরায় বৃদ্ধি পাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য একটি চিন্তার বিষয়। দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এবং মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।