বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতিবছর প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে । সাধারণত কিশোর-কিশোরী আর যাদের বয়স ৩৫ বছরের নিচে তারাই বেশি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
আত্মহত্যা কী:
আত্মহত্যা হলো ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া।
জানা গেছে, নারীদের তুলনায় পুরুষদের আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে মানসিক অসুস্থতা, বিষণ্ণতা,ব্যক্তিত্ব ও আবেগের সমস্যা, মাদকদ্রব্য গ্রহণকারী, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি।
পৃথিবীতে বছরে ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
বাংলাদেশে বছরে ১০ হাজার জন আত্মহত্যা করে। পাশ্চাত্যে, মধ্য বা শেষ বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি। বিশেষ করে মধ্যবয়সী পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।
মানুষ কেন আত্মহত্যার পথে পা বাড়ায় :
আত্মহত্যার প্রধান একটি কারণ হলো ডিপ্রেশন।
ডিপ্রেশন বা হতাশা থেকে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, অনিদ্রা, ক্যান্সার, ব্লাডপ্রেসারসহ বহু জটিল রোখ দেখা দিচ্ছে ফলে রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছ।
এছাড়াও পারিবারিক নির্যাতনের শিকার, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা, দাম্পত্য কলহ, প্রেম বা পরকীয়ায় ব্যর্থতা, বেকারত্ব, দারিদ্রতা, মানসিক অসুস্থতার ফলে মানুষ ডিপ্রেশনে চলে যায়। ফলে বেছে নেয় আত্মহননের পথ যা খুবই দুঃখজনক ।
ডিপ্রেশন মানুষের ভেতরটাকে অস্থির ও বিষণ্ণ করে তোলে । ফলে জীবন সম্পর্কে বিরক্তি চলে আসে। নেতিবাচক চিন্তাধারা মাথায় ঘুরপাক করতে শুরু করে।
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায় মানুষ যার কারনে জীবন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে এবং বেছে নেয় আত্মহননের পথ।
আত্মহত্যার প্রকারভেদ : আমাদের চারপাশে দুই ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ।
1.ডিসিসিভ সুইসাইড : পরিকল্পনা করে সুইসাইড নোট লিখে যারা আত্মহত্যা করেন।
2. ইমপালসিভ সুইসাইড :
এরা পরিকল্পনা করে সুইসাইড করেন না। হুট করেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ।
নিজেকে কষ্ট দিতে যারা নিজের হাত পা কাটে, ঘুমের ওষুধ খায় তাদের ক্ষেত্রেই এই ধরণের আত্মহত্যা করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
আপনার আশেপাশে কাউকে যদি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে দেখেন তাহলে তাকে সেই পথ থেকে সরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করুন।
আত্মহত্যার প্রধান কারণ যেহেতু ডিপ্রেশনে তাই কাউকে ডিপ্রেশনে চলে যেতে দেখলে ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করুন।
আত্মহত্যা একটি মানসিক ব্যাধি। যখন কেউ ডিপ্রেশনের শেষ অবস্থায় পৌছে যায় তখনই আত্মহত্যার দিকে প্ররোচিত হয়।
কেউ ডিপ্রেশনে আছে যেভাবে বুঝবেন :
- এরা একটুতেই ঘাবড়ে যায়, একটুতেই ভেঙে পড়ে। খুব সহজেই ইমোশনাল হয়ে যায়। মনে রাখবেন ইমোশন ভালো কিন্তু অতিরিক্ত ইমোশন ভালো না যা ডিপ্রেশনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
- নিজেকে কষ্ট দেয় বা হাত পা কেটে ফেলে।
- কাজের প্রতি অনীহা পোষণ করে।
- অহেতুক চিন্তা করে উত্তেজিত হয় এবং ঘাবড়ে যায়।
- অনেক সময় হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে ডিপ্রেশন বাসা বাঁধে বয়সন্ধিকালে এই ধরনের অবস্থা লক্ষ্য করা যায়।
- জীবনের প্রতি ঘৃণা বা উদাসীন হয়ে পড়ে।
- অল্পতে সন্তুষ্ট থাকে না।
- নেশা জাতীয় দ্রব্যের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তিও ডিপ্রেশনের কারণ
- সবসময় নিজেকে দোষী ভাবে। সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে।
- অল্পতেই মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। কারও কথা শুনতে চায় না।
অন্যকে আত্মহত্যার পথ থেকে যেভাবে ফিরিয়ে আনবেন :
যদি ডিপ্রেশনের কারণ খুঁজে বের করতে পারেন তাহলে উপযুক্ত মেডিটেশন ও ডাক্তারের সহযোগিতায় খুব সহজেই ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব
তাছাড়া নিয়মিত কাউন্সেলিং , ব্যায়াম ও মনকে পরিবর্তন করতে পারলে ডিপ্রেশনে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
☆ যেমন আনন্দ থাকলে দুঃখও থাকবে একে মেনে নেওয়ার মন মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
☆ স্রষ্টার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে ।
☆চিন্তাধারার পরিবর্তন আনতে হবে এবং পজিটিভ চিন্তা মাথায় আনতে হবে ।
☆নিজের কাউন্সেলিং নিজে করতে হবে। মনকে দমন না করে ভালো চিন্তাধারার মাধ্যমে পরিবর্তন করা দরকার ।
☆মনকে শক্তিশালী করুন এবং যত বেশি সিম্পল থাকবেন ততবেশি ডিপ্রেশন থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন।
☆উচ্চাবিলাসি আকাঙ্খা থেকে সরে আসতে হবে।
☆ নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অনুসরণ করে চলে ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
☆ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নিজের মনের নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টিকর্তার দিকে সমর্পণ করলে হতাশামুক্ত থাকা যায়।
☆রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
☆গভীরভাবে ৩ -৪ বার শ্বাস নিলে রাগ অনেকটাই কমে যায়।
☆নিজের ইচ্ছানুযায়ী জগতের সবকিছু হবে এমন ইচ্ছা করা বৃথা তাই ইগোকে দূরে সরিয়ে সবকিছু মেনে নেওয়া দরকার। বন্ধুবান্ধব, বাবা -মা সহপাঠী দের এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে যাতে করে সে যেন একাকিত্ব অনুভব না করে এবং তাকে উৎসাহ প্রদান করতে হবে ।
☆টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া অনেক সময় ডিপ্রেশন এর কারণ হতে পারে । তাই প্রয়োজন অনুসারে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার করা উচিত নাহলে জীবনটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
☆তবে যাদের আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয় তাদের একা হাতে সবকিছু সামলানোর চেষ্টা করা উচিত নয়। বন্ধু বা পরিবারের সাথে খোলামেলা আলোচনা করুন প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
☆জীবন সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি করুন।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে যা করা দরকার :
- মনে রাখবেন, আত্মহত্যা বা জীবন নষ্ট করা কখনও সমাধানের পথ হতে পারে না। তাই আত্ম হত্যার প্রতিরোধে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে এক্ষেত্রে পরিবারকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
সন্তানদের উচিত বাবা-মার সাথে কোলাকুলি কথা বলা ।
ইদানিং দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র , প্রকৌশল বিজ্ঞানের ছাত্র, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে স্কুলপড়ুয়া কিশোর কিশোরীরা পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে যা মোটেও কাম্য নয়। এর জন্য প্রয়োজনীয় কাউন্সিল জরুরি।
আত্মহত্যা যেভাবে কমানো সম্ভব :
☆ আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য বিষয়। সঠিক সময় উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আত্মহত্যা অবশ্যই ঠেকানো যাবে।
☆ আত্মহত্যার যেসব উপকরণ যেমন – ঘুমের ঔষধ বা কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমাতে হবে।
☆প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ঔষধ বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
☆ডিপ্রেশনের কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং এর সমাধানের পথ খুঁজে বের করুন।
☆পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটান। আনন্দ, দুঃখ, সফলতা ব্যর্থতাকে মেনে নিতে শিখুন তাহলেই জীবন সুন্দর হবে ।
☆ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসুন। ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ করুন ।
কারণ শারীরিক সুস্থতার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার শক্তিশালী সম্পর্ক আছে ।
☆গবেষণায় দেখা গেছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিশ্বাস উত্তেজনা মোকাবেলায় মানুষকে হেফাজত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
☆চিকিৎসাবিদরা ও মানসিক কষ্ট বা ডিপ্রেশনমুক্ত থাকার জন্য ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
মানসিক চাপ মানুষের ভেতরকে অস্থির ও বিষণ্ন করে তোলে ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায় আমাদের মনে।
আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং যা আমাদের মনের উপর প্রভাব ফেলে।মনে হয় আর কোন পথ নেই এবং আমরা জীবনকে বর্তমান মুহূর্তের খুবই সংকীর্ণ প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। মৃত্যুই যেন হয়ে ওঠে জগতের যাবতীয় সমস্যার সমাধান ।
তাই আমরা আত্মহননের পথে পা বাড়াই। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখুন আত্মহত্যা বা সুইসাইড কখনও জীবনের সমাধান হতে পারে না।
আপনার দৃষ্টিতে হয়তো এখন মৃত্যুই জীবনের সমাধান মনে হচ্ছে কিন্তু হতে পারে কিছুসময় পরে আপনার ধারণার পরিবর্তন হতে পারে। জীবনটা তখন সম্পূর্ণ অন্যরকম দেখাবে।
ডিপ্রেশনের অসহ্য যন্ত্রণায় আপনি হয়তো আত্মহননের পথটা বেছে নিচ্ছেন কিন্তু যখন আপনার মৃত্যু মুহূর্ত উপস্থিত হবে তখন আপনার জীবনের সমস্যার কথা মনেই হবে না।
শুধু মনে হবে যদি আরেকটাবার বাচার সুযোগ পেতাম তাহলে জীবনটাকে নতুনভাবে শুরু করতাম।
যারা একসময় আত্মহত্যার কথা ভেবেছিল তাদের মধ্যে বেশিরভাগই আজ বেচে আছে বলে সুখী ।
যখন আপনি জীবনের এই সত্যটা উপলব্ধি করতে পারবেন তখন হয়তো আর কিছুই করার থাকবে না।
তাই মন থেকে নেতিবাচক ধারণা ঝেড়ে ফেলুন । সুস্থভাবে নিজের জন্য বাঁচুন।
পরিবারকে সময় দিন।
ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন । স্রষ্টার কাছে দু হাত তুলে প্রার্থনা করুন। সব ধর্মেই মূলত আত্নহত্যার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
আত্মহত্যা হলো পাপ ও চরম ঘৃণিত কাজ। তাই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন।
একটা কথা মনে রাখবেন স্রষ্টা আপনাকে উপহারস্বরূপ জীবন দান করেছেন। সেই উপহারের যথাযথ মূল্য দেওয়ার চেষ্টা করুন। তাহলেই জীবন হবে সুন্দর ও পরিপূর্ণ ।