প্রতিনিধি ১৩ অগাস্ট ২০২৫ , ১০:৪৯ এএম প্রিন্ট সংস্করণ
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সম্প্রতি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের জন্য যে প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করেছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বেশিরভাগ দলই প্রস্তাবগুলোকে ইতিবাচকভাবে দেখছে, কারণ তাদের কিছু পুরোনো দাবি এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে তারা আপত্তি, ভিন্নমত ও সতর্কতার কথাও জানিয়েছে। বর্তমানে সংসদ না থাকায়, এসব প্রস্তাব এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের কাছে যাবে এবং অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এগুলো আইনে পরিণত হবে।
আরপিও সংশোধনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে সশস্ত্র বাহিনীকে ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা। এই প্রস্তাবে ‘সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী’কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি-র মতো দলগুলো ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। এর ফলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও পুলিশের মতো ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এবং বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবেন।
এছাড়াও, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার সংক্রান্ত সব বিধান বাতিল করা এবং কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে সেখানে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাবকে দলগুলো স্বাগত জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের মনে করেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে এটি সাহায্য করবে। অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই প্রস্তাবকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখে, তবে তারা চায় ‘না’ ভোটের বিধান যেন একক প্রার্থীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং সব প্রার্থীর ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য হয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো, নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত এবং বাতিল করার ক্ষেত্রে ইসির ক্ষমতা বাড়ানো। অর্থাৎ, কমিশন পরিস্থিতি অনুযায়ী এক বা একাধিক ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের নির্বাচন স্থগিত বা ফলাফল বাতিল করতে পারবে। এনসিপি এই ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছে, কারণ অতীতে নির্বাচন কর্মকর্তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণের ঘটনা ঘটেছে।
সব প্রস্তাবকে একবাক্যে মেনে নেয়নি রাজনৈতিক দলগুলো। বেশ কিছু বিষয়ে তাদের ভিন্নমত ও সতর্কতার বার্তা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, রাজনৈতিক দলের অনুদান সর্বক্ষেত্রে ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রহণ করার বিধান। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ এবং গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, ছোটখাটো অনুদান রসিদের মাধ্যমে নেওয়ার সুযোগ থাকা উচিত, কারণ রাজনৈতিক হয়রানির ভয়ে অনেক দাতা তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে চান না।
এছাড়াও, পুরো আসনের ভোট বাতিলের বিষয়ে ইসির ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকার কথা বলেছে বিএনপি ও জামায়াত। তাদের মতে, যথাযথ তথ্য-প্রমাণ ও তদন্তসাপেক্ষে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে, যাতে কোনো উদ্দেশ্যমূলক অভিযোগের কারণে কোনো অন্যায় সিদ্ধান্ত না হয়।
জোটগতভাবে নির্বাচনে নিজেদের প্রতীকে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব নিয়েও ভিন্নমত রয়েছে। বিএনপি এবং নাগরিক ঐক্য এই প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও, জামায়াত ও গণসংহতি আন্দোলন মনে করে, এ বিষয়ে দলগুলোর নিজস্ব স্বাধীনতা থাকা উচিত এবং তাদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো কিছু দল ইসির প্রস্তাবগুলোকে ভালো বললেও, বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে তাদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, “ইসি’র প্রস্তাবের অনেকগুলো আমাদের দাবিও ছিল। এটাকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। কিন্তু সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ করতে পারবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন, সেটাই শঙ্কার জায়গা।”
সংক্ষেপে বলা যায়, আরপিও সংশোধনে ইসির প্রস্তাবগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একদিকে যেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের প্রস্তাবনা নিয়ে তারা খুশি, অন্যদিকে অনুদান গ্রহণ ও ইসির ক্ষমতা প্রয়োগের মতো কিছু বিষয়ে তাদের সুস্পষ্ট আপত্তি রয়েছে। এই প্রস্তাবগুলো চূড়ান্তভাবে আইনে পরিণত হলে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।