প্রতিনিধি ১১ অগাস্ট ২০২৫ , ১২:৫৭ পিএম প্রিন্ট সংস্করণ
শেন ওয়ার্ন এবং ওল্ড ট্র্যাফোর্ড— এই দুটি নাম একসঙ্গে শুনলে যেকোনো ক্রিকেটপ্রেমীর চোখের সামনে ভেসে ওঠে ১৯৯৩ সালের অ্যাশেজের সেই ‘শতাব্দীর সেরা ডেলিভারি’। মাইক গ্যাটিংকে বোকা বানিয়ে যে বলটি ওয়ার্ন করেছিলেন, তা আজও ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল। তবে, এই মাঠের সঙ্গে ওয়ার্নের সম্পর্কের শেষ নয় সেখানেই। ঠিক ১২ বছর পর এই ঐতিহাসিক মাঠেই তিনি জন্ম দিয়েছিলেন আরও একটি অবিস্মরণীয় মুহূর্তের। আজ থেকে ঠিক ২০ বছর আগে, টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসেবে স্পর্শ করেছিলেন ৬০০ উইকেটের মাইলফলক।
২০০৫ সালের সেই অ্যাশেজ সিরিজকে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা সিরিজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সিরিজে তখন ১-১ এ সমতা। লর্ডসে অস্ট্রেলিয়া বড় ব্যবধানে জিতলেও, এজবাস্টনে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে মাত্র ২ রানে হেরেছিল। এমন পরিস্থিতিতে সিরিজের তৃতীয় টেস্ট শুরু হয় ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে।
৬০০ উইকেটের মাইলফলক থেকে তখন মাত্র একটি উইকেট দূরে ছিলেন ওয়ার্ন। প্রথম দুই টেস্টে ১৬ উইকেট শিকার করে তিনি এই অবস্থানে পৌঁছান। ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে টস জিতে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক মাইকেল ভন প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন। অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস দ্রুত আউট হলেও, ভন এবং মার্কাস ট্রেসকোথিক মিলে গড়ে তোলেন একটি দারুণ শতরানের জুটি।
ইংল্যান্ডের দুই ব্যাটসম্যান যখন ব্যাট হাতে ঝড় তুলছেন, তখন পেসাররা উইকেটের তেমন কোনো সহায়তা পাচ্ছিলেন না। লাঞ্চের পরেও অধিনায়ক রিকি পন্টিং পেসারদের দিয়েই চেষ্টা চালান। অবশেষে ৩৪তম ওভারে ওয়ার্নের হাতে বল তুলে দেন তিনি। এই স্পিন জাদুকর শুরু থেকেই ট্রেসকোথিক ও ভনকে চাপে ফেলতে শুরু করেন। তার পঞ্চম ওভারেই ঘটে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
ওয়ার্নের অফ স্টাম্পে পিচ করা ডেলিভারিটি ট্রেসকোথিক সুইপ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু বলটি তার গ্লাভস ছুঁয়ে উইকেটকিপার অ্যাডাম গিলক্রিস্টের উরুতে লেগে উপরে উঠে যায়। এরপর গিলক্রিস্ট বলটি গ্লাভসে জমিয়ে নিতেই আম্পায়ার বিলি বাউডেন আঙুল তুলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ন দুই হাত তুলে তার ট্রেডমার্ক উদযাপনে মেতে ওঠেন। সতীর্থরা তাকে ঘিরে ধরে অভিনন্দন জানাতে শুরু করেন।
ধারাভাষ্যকার মার্ক নিকোলাসের কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল, “সিক্স হান্ড্রেড টেস্ট ম্যাচ উইকেটস ফর শেন ওয়ার্ন, হোয়াট আ মোমেন্ট…।” গ্যালারিতে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে সম্মান জানাচ্ছিল তাদের প্রিয় স্পিন কিংবদন্তিকে। করতালির জোয়ার বইছিল দীর্ঘ সময় ধরে। ওভার শেষে ওয়ার্ন টুপি খুলে সবার অভিবাদনের জবাব দেন।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওয়ার্ন তখন বলেছিলেন, “৬০০ উইকেট পাওয়া, এর আগে কেউ কখনও এমন কিছু করতে পারেনি। এই অর্জনের জন্য আমি বেশ গর্বিত। এই মাঠে এটি করতে পারাটা দারুণ স্পেশাল, তার ওপর আমার বাবা-মাও এখানে আছেন।”
ওই টেস্টে ওয়ার্ন প্রথম ইনিংসে ৯০ রান করেন, যা ছিল দলের সর্বোচ্চ। এরপর ৪২৩ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া যখন হারের মুখে, তখন তিনি পন্টিংয়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে দলকে রক্ষা করেন। ৯৯ মিনিট ক্রিজে থেকে ৬৯ বলে ৩৪ রানের এক লড়াকু ইনিংস খেলেছিলেন। পন্টিংয়ের ১৫৬ রানের মহাকাব্যিক ইনিংসের সাথে ওয়ার্নের এই প্রতিরোধও ম্যাচ বাঁচানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ওই সিরিজ অস্ট্রেলিয়া ২-১ ব্যবধানে হেরে গেলেও, ওয়ার্ন ছিলেন অসাধারণ। ৫ টেস্টে মাত্র ১৯.৯২ গড়ে তিনি ৪০ উইকেট নিয়েছিলেন, যা ছিল তার ক্যারিয়ারের সেরা সিরিজ পারফরম্যান্স। এর পরের বছরই তিনি টেস্ট ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসেবে ৭০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন এবং ২০০৭ সালে ৭০৮ উইকেট নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানান।
২০২২ সালের মার্চে মাত্র ৫২ বছর বয়সে এই কিংবদন্তি ক্রিকেটার পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তবে তার করা কীর্তিগুলো ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। প্রায় দেড়শ বছরের টেস্ট ইতিহাসে ওয়ার্নের চেয়ে বেশি উইকেট রয়েছে কেবল শ্রীলঙ্কার স্পিন গ্রেট মুত্তাইয়া মুরালিধরনের (৮০০)।