বিনোদন

ঢালিউড কি শুধু ঈদের জন্য? সংকটে সিনেমা শিল্প, দর্শক হারাচ্ছে হলগুলো

  প্রতিনিধি ২০ অগাস্ট ২০২৫ , ১১:৩১ এএম প্রিন্ট সংস্করণ

ঢালিউড কি শুধু ঈদের জন্য? সংকটে সিনেমা শিল্প, দর্শক হারাচ্ছে হলগুলো

ঢালিউড কি এখন শুধু ঈদকেন্দ্রিক? ঈদুল আজহার তিন মাস পেরিয়ে গেলেও নতুন বাংলা সিনেমার পোস্টার খুঁজলে হতাশ হতে হয়। স্টার সিনেপ্লেক্সের বাইরে দুই তরুণ, যারা ‘উড়াল’ সিনেমার টিকিট হাতে অপেক্ষা করছেন, তাদের কথোপকথন যেন পুরো বাংলা সিনেমার বর্তমান চিত্র তুলে ধরেছে—‘এখন ঈদ ছাড়া ছবি চলে না। কোনো ছবি নাই।’ তাদের এই হতাশা শুধু তাদের একার নয়, বরং ঢালিউড পাড়ার সব প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা এবং সর্বোপরি দর্শকদের মনের কথা।

ঈদের সময় একসঙ্গে ছয়টি সিনেমা মুক্তি পেলেও, তারপর গত তিন মাসে মুক্তি পেয়েছে মাত্র তিনটি—‘আলী’, ‘উড়াল’ এবং ‘জলরঙ’। এর মধ্যে ‘জলরঙ’ ছবিটি আগে ওটিটিতে মুক্তি পেয়েছিল। অর্থাৎ, দুই মাস ধরে কোনো নতুন সিনেমা মুক্তি পায়নি। অথচ, এই সময়ের মধ্যে শাকিব খান, সিয়াম আহমেদ, শরিফুল রাজ, মোশাররফ করিমসহ আরও অনেক অভিনেতাকে নিয়ে ১০টির মতো নতুন সিনেমা নির্মাণের খবর শোনা গেছে। এর মধ্যে পাঁচটি আগামী ঈদুল ফিতরে মুক্তির জন্য তৈরি হচ্ছে। এ যেন এক অদ্ভুত চক্র। বছরের বাকি সময়টা ঢালিউড কার্যত নীরব থাকে, আর ঈদের সময়টা যেন বাংলা সিনেমার এক মৌসুমী উৎসব।

চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ঈদকেন্দ্রিকতা ঢালিউডকে আরও বড় সংকটে ফেলছে। পরিচালক কাজী হায়াৎ মনে করেন, ‘এভাবে সিনেমা বাঁচবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ছিল না, কারণ একটি ইন্ডাস্ট্রির জন্য যা দরকার, তা আমাদের নেই। দর্শক কোথায় সিনেমা দেখবে, কী সিনেমা দেখবে? সেই দর্শক কি আমরা তৈরি করতে পারছি? শুধু ঈদ ঘিরে সিনেমা মুক্তি দেওয়ায় ঢালিউড এখন আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে।’ তার মতে, এটি এখন মৌসুমি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, যেখানে কিছু মানুষ শুধু সুযোগ বুঝে ব্যবসা করছে।

সিনেমা প্রদর্শক সমিতির নেতা আলাউদ্দিন মাজিদও একই কথা বলছেন। তিনি জানান, ঈদের সিনেমাগুলো দুই থেকে তিন মাস ধরে চলে, কিন্তু এরপর হলগুলো কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। অনেকেই হল বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছেন কারণ, রোজার ঈদ পর্যন্ত ৭-৮ মাস কীভাবে হল চালানো যাবে, তা নিয়ে কেউ ভাবছে না। এই অবস্থা মাল্টিপ্লেক্সগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই দেখছি সবাই ঈদকেন্দ্রিক সিনেমা নির্মাণ করছেন। আমরা এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এখন কন্টেন্ট না থাকায় দর্শক হারিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি মনে করেন, ঈদ ছাড়াও পয়লা বৈশাখ, ভালোবাসা দিবস, দুর্গাপূজা এবং ডিসেম্বরের ছুটির মতো সময়গুলোকে কাজে লাগানো উচিত।

ঈদে শাকিব খানের সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর অনেকেই পিছিয়ে যান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সাবেক প্রযোজক ও প্রদর্শক সমিতির নেতা বলেন, শাকিব খানের বছরে শুধু দুই ঈদের সিনেমায় শুটিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়া ঢালিউডে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার মতোই। কারণ বড় তারকার সিনেমা যদি ঈদের বাইরে মুক্তি না পায়, তাহলে অন্যরা কেন সিনেমা নিয়ে আসবে? এতে নতুন প্রযোজকদের আগ্রহ কমে যায়।

এর ফলে ঢালিউডে একদিকে যেমন নতুন সিনেমা নির্মাণ কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে কলাকুশলীদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে। পরিচালক সমিতির তথ্যমতে, ৯৫ শতাংশ পরিচালক বেকার। তারা সিনেমা নির্মাণের জন্য প্রযোজক খুঁজে পাচ্ছেন না। বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত পরিচালক রায়হান রাফী, যিনি ‘পরাণ’, ‘তুফান’ ও ‘তাণ্ডব’ দিয়ে দর্শক টেনেছেন, তিনিও গত চার বছরে ঈদ ছাড়া কোনো সিনেমা মুক্তি দেননি। তিনি জানান, ‘আমাদের ইন্ডাস্ট্রি এখনো স্টেবল না। ঈদে সিনেমা মুক্তি পেলে লগ্নি ফিরে পেতে সুবিধা হয় প্রযোজকের।’ তবে তিনি আশাবাদী যে সামনে ঈদ ছাড়াও অন্য সময়ে সিনেমা মুক্তি পাবে। তিনি নিজেই আগামী ডিসেম্বরে একটি সিনেমা মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

ঢালিউডকে এই সংকট থেকে বের হতে হলে ঈদকেন্দ্রিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সারা বছর ধরে সিনেমা নির্মাণ ও মুক্তি দেওয়া হলে দর্শক নিয়মিত হলে আসবে, হলগুলো বাঁচবে এবং পুরো বাংলা সিনেমা শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। তা না হলে এই শিল্প শুধু দুই ঈদের মৌসুমি ব্যবসায় পরিণত হবে, যেখানে দর্শক ও সিনেমা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।