প্রতিনিধি ২৩ অগাস্ট ২০২৫ , ১০:২৬ এএম প্রিন্ট সংস্করণ
দীর্ঘদিন ধরে চলা সীমাহীন অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার কারণে অবশেষে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে দেশের ৯টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে না পারা, খেলাপি ঋণের পাহাড় এবং প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব প্রতিষ্ঠানকে ‘অপরিচালনযোগ্য’ ঘোষণা করে তাদের অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে স্বস্তির খবর হলো, সরকার ক্ষুদ্র আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেবে এবং চাকরি হারানো কর্মচারীরাও নিয়ম অনুযায়ী সব সুবিধা পাবেন।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের নেতৃত্বে একটি জরুরি বৈঠকে এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফিন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২৩ অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স বাতিলের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেজল্যুশন বিভাগ।
যে ৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে, সেগুলো হলো—পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, আভিভা ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি এবং প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানাচ্ছে, এই ৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট নিট ব্যক্তিগত আমানতের পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। অবসায়নের প্রথম ধাপেই এই টাকা পরিশোধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের প্রায় পুরোটাই খেলাপি। উদাহরণস্বরূপ, এফএএস ফাইন্যান্সের ৯৯.৯৩ শতাংশ, ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ৯৮ শতাংশ, বিআইএফসির ৯৭.৩০ শতাংশ এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৯৬ শতাংশ ঋণই খেলাপি। শুধু ইন্টারন্যাশনাল লিজিং একাই প্রায় ৩ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ জমিয়েছে, যার বেশিরভাগই আদায় করা সম্ভব নয়।
পিপলস লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের হার ৯৫ শতাংশ, যার লোকসান ৪ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। আভিভা ফাইন্যান্সের খেলাপি ৮৩ শতাংশ, লোকসান ৩ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। প্রিমিয়ার লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ ৭৫ শতাংশ এবং লোকসান ৯৪১ কোটি টাকা। জিএসপি ফাইন্যান্সের ৫৯ শতাংশ ঋণ খেলাপি এবং লোকসান ৩৩৯ কোটি টাকা। আর প্রাইম ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণের হার ৭৮ শতাংশ, যার লোকসান ৩৫১ কোটি টাকা।
ফিন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২৩-এর ৭(১) ধারা অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠান যদি আমানতকারীদের স্বার্থবিরোধী কাজ করে, দায় পরিশোধে ব্যর্থ হয় বা মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার লাইসেন্স বাতিল করা যায়। এই আইন মেনেই গত ২২ মে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক চূড়ান্তভাবে অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বর্তমানে দেশে মোট ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে ২০টি প্রতিষ্ঠানকে ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই ২০টি প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২১ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি, যা প্রায় ৮৩.১৬ শতাংশ। এই পরিস্থিতিতে দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপকে অনেকেই সাধুবাদ জানাচ্ছে।