চাকরি

বাংলাদেশে এনজিও: শুধু চাকরি নয়, সামাজিক পরিবর্তনের এক নতুন দিশা

  প্রতিনিধি ২৪ অগাস্ট ২০২৫ , ৯:৪৬ এএম প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশে এনজিও: শুধু চাকরি নয়, সামাজিক পরিবর্তনের এক নতুন দিশা

বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বর্তমানে পেশা হিসেবে উন্নয়ন সংস্থা বা ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনগুলোর প্রতি আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। শুধুমাত্র ভালো বেতন বা আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য নয়, বরং সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সুযোগ এবং মানুষের জীবনকে সরাসরি স্পর্শ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এই আগ্রহের মূল কারণ। তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছ এবং উন্নত কর্মপরিবেশও এই খাতকে তরুণদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা ফারিয়া আক্তার সোমা দীর্ঘদিন বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেছেন। তার মতে, “আমি সবসময় ভেবেছি, চাকরি মানে শুধু আয়রোজগার নয়, এর সঙ্গে মানুষের জীবনে কিছু বদল আনার সুযোগ থাকা উচিত। এই জায়গা থেকেই আমি এনজিও-র কাজটাকে উপভোগ করেছি।” ফারিয়ার মতো আরও অনেক তরুণ-তরুণী এই খাতকে শুধু একটি চাকরি নয়, বরং সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেখেন। এখানে নীতি প্রণয়ন, প্রকল্প বাস্তবায়ন, মাঠপর্যায়ের সমন্বয় এবং জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো অন্তর্ভুক্ত।

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে এনজিও খাত ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। স্থানীয় থেকে আন্তর্জাতিক—সব ধরনের সংস্থাই মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করছে। এই খাতের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো এটি সরাসরি মানবকল্যাণের সঙ্গে যুক্ত, যা অন্য কোনো বাণিজ্যিক খাতে খুব কমই দেখা যায়। তরুণ প্রজন্মের কাছে এখন এটি শুধু ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা’ নয়, বরং একটি শক্তিশালী ক্যারিয়ার ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এখানে রয়েছে দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ, বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ, বিদেশে কাজের অভিজ্ঞতা এবং উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পথ।

আন্তর্জাতিক এনজিও যেমন ইউনিসেফ, ইউএনডিপি, রেড ক্রস, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন তাদের কর্মীদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও মেন্টরশিপের ব্যবস্থা করে। এতে একজন কর্মী শুধু তার দায়িত্ব পালন করেন না, বরং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও বেশি প্রস্তুত ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) অধ্যাপক রিদওয়ানুল হক মনে করেন, উন্নয়ন খাতে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের অবশ্যই বৈশ্বিক সামাজিক ও ব্যবসায়িক নীতি নিয়ে গভীর আগ্রহ এবং ধৈর্য ধরে পড়াশোনার মানসিকতা থাকতে হবে। পাশাপাশি, নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বোঝা এবং সেই অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি কৌশল তৈরির সক্ষমতাও থাকা প্রয়োজন।

উন্নয়ন খাতে ক্যারিয়ার শুরু করতে সাধারণত প্রজেক্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট, ফিল্ড অফিসার বা রিসার্চ অ্যাসোসিয়েটের মতো পদ থেকে শুরু করা হয়। এই পর্যায়টি মূলত মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা অর্জন এবং প্রাথমিক প্রকল্প পরিচালনার দক্ষতা অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তানভীর তুষার, একজন মেন্টর হিসেবে কাজ করা তরুণ, জানান, “আমি শুরুতে সামাজিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করেছি। এখন আমি নিয়মিত শহুরে বস্তি এলাকায় গিয়ে সরাসরি মানুষের সঙ্গে কাজ করছি। তাদের জীবনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার এই অনুভূতিটা অসাধারণ।”

এনজিও-তে পদোন্নতি ধাপে ধাপে হয়ে থাকে। একজন প্রজেক্ট অফিসার কাজ এবং দক্ষতা অনুযায়ী প্রোগ্রাম ম্যানেজার, টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, এমনকি কান্ট্রি ডিরেক্টর পর্যন্ত হতে পারেন। তবে এই অগ্রগতি নির্ভর করে কাজের পারফরম্যান্স, দক্ষতা, এবং নেটওয়ার্কিংসহ অন্যান্য যোগ্যতার ওপর।

এই খাতে কাজ করতে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি কিছু বিশেষ দক্ষতাও থাকা প্রয়োজন। সাধারণত, সামাজিক বিজ্ঞান, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, পাবলিক হেলথ, অর্থনীতি বা মানবিক বিষয়ে ডিগ্রি থাকা ভালো। প্রযুক্তিগত দক্ষতার মধ্যে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট (PMD Pro), ডেটা বিশ্লেষণ (যেমন Excel, SPSS, STATA), এবং বাজেট পরিকল্পনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও, যোগাযোগ, বহু-সাংস্কৃতিক পরিবেশে কাজ করার সক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের মনোভাব এবং ইংরেজি ভাষার দক্ষতা থাকা জরুরি। আন্তর্জাতিক প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকলে অগ্রাধিকার পাওয়া যায়।

তবে এই খাতে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। চাকরির স্থায়িত্ব একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ অনেক প্রকল্প নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য হয়। এছাড়াও, মাঠপর্যায়ের কাজ করার সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সামাজিক ঝুঁকির মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়।

বাংলাদেশের উন্নয়ন খাত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং প্রযুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো খাতে দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়ছে। একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন, শিক্ষা এবং কৃষি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সবচেয়ে বেশি। তাই এই খাতে দীর্ঘ মেয়াদে সফল হতে হলে তরুণদের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করা উচিত।