অর্থনীতি

বিমা খাতে নতুন ঝুঁকি: শীর্ষ ৫ কোম্পানির হাতে জিম্মি পুরো খাত?

  প্রতিনিধি ২৪ অগাস্ট ২০২৫ , ১০:১০ এএম প্রিন্ট সংস্করণ

বিমা খাতে নতুন ঝুঁকি: শীর্ষ ৫ কোম্পানির হাতে জিম্মি পুরো খাত?

দেশের বিমা খাত এখন এক গভীর সংকটের মুখোমুখি। দেশের শীর্ষ পাঁচ বিমা কোম্পানির হাতেই আটকে আছে পুরো খাতের সম্পদ ও প্রিমিয়ামের সিংহভাগ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই শীর্ষ কোম্পানিগুলোর কোনো একটিতে যদি বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়, তাহলে তার প্রভাব পড়বে পুরো বিমা খাতে, যা দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের বিমা খাতের এই অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ বা ‘কন্সেন্ট্রেশন’ খাতের স্বাভাবিক প্রতিযোগিতাকে কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে ছোট ছোট কোম্পানিগুলো বাজারে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে এবং গ্রাহকদের জন্য নতুন নতুন পণ্য বা সেবার বৈচিত্র্যও সীমিত হচ্ছে।

 

জীবন বিমা খাতে শীর্ষদের দাপট

 

জীবন বিমা খাতে মোট সম্পদের পরিমাণ ৪৮ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৭৭ শতাংশ বা ৩৭ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকার সম্পদই আছে শীর্ষ পাঁচটি কোম্পানির দখলে। এই কোম্পানিগুলোর হাতেই রয়েছে ৬৫ শতাংশেরও বেশি প্রিমিয়াম। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, সরকারি প্রতিষ্ঠান জীবন বীমা করপোরেশন একাই এ খাতের ৬.৪৫ শতাংশ সম্পদ এবং ৭.০১ শতাংশ প্রিমিয়াম নিয়ন্ত্রণ করছে। এই উচ্চ ঘনত্ব বিমা খাতের ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে।

নন-লাইফ বিমা খাতেও চিত্রটা একই। ২০ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার মোট সম্পদের মধ্যে শীর্ষ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের দখলে আছে ৬২.৬৭ শতাংশ বা ১২ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার সম্পদ। প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে তাদের হিস্যা ৫৬.০২ শতাংশ। এখানেও সরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশন একাই ৪২.১৭ শতাংশ সম্পদ এবং ২৭.১০ শতাংশ প্রিমিয়ামের মালিক।

 

আন্তঃসংযোগ ও বাজারের ঝুঁকি

 

বিমা খাত এককভাবে কাজ করলেও এর আর্থিক কর্মকাণ্ড সরাসরি দেশের ব্যাংক, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাজার এবং বন্ড বাজারের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। জীবন বিমা কোম্পানিগুলো তাদের মোট বিনিয়োগের প্রায় ৬৩ শতাংশ সরকারি বন্ডে রেখেছে। অন্যদিকে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাদের স্থায়ী আমানত (FDR) কমেছে। ২০২৩ সালে যা ছিল ১৫.৫৭ শতাংশ, ২০২৪ সালে তা নেমে এসেছে ১৩.২৫ শতাংশে।

তবে এই আমানত ব্যাংক খাতের মোট আমানতের মাত্র ০.৯৫ শতাংশ হওয়ায়, বিমা কোম্পানিগুলো হঠাৎ করে তাদের টাকা তুলে নিলেও ব্যাংক খাতে বড় কোনো চাপ তৈরি হবে না। কিন্তু এর উল্টোটা হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। অর্থাৎ, কোনো কারণে যদি ব্যাংক বা আর্থিক খাতে ধস নামে, তবে বিমা খাতও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

বিনিয়োগের আরও ১০.৫৯ শতাংশ রাখা হয়েছে পুঁজিবাজারে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত বিমা কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত বাজার মূলধন ২০২৩ সালে ৩.৮৭ শতাংশ থেকে কমে ২০২৪ সালে ৩.৫৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এর মানে, শেয়ারবাজারে বিমা খাতের প্রভাব সীমিত হলেও, বাজারের দুর্বল পারফরম্যান্স সরাসরি বিমা কোম্পানিগুলোর আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাজারের মন্দা বিমা কোম্পানিগুলোর ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে।

 

ভবিষ্যতের দিকে সতর্ক দৃষ্টি

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের বিমা খাতে এই কেন্দ্রীকরণ একটি মারাত্মক ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে। যদি শীর্ষ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কোনো একটিতে বড় ধরনের সংকট দেখা দেয়, তাহলে তা পুরো খাতকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। এর ফলে নতুন ও ছোট কোম্পানিগুলোর পক্ষে বাজারে টিকে থাকা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে, যা গ্রাহকের জন্য পণ্য ও সেবার বৈচিত্র্য আরও সীমিত করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছে যে বিমা খাতের এই উচ্চ ঘনত্ব এবং আন্তঃসংযোগ পুরো খাতটিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। তাই সঠিক নীতি এবং কঠোর নজরদারি না থাকলে এই খাত অচিরেই আরও বড় ঝুঁকির মুখে পড়বে, যা দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বিমা খাতের জন্য এখনই সময়, এই ঝুঁকিগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।