জাতীয়

ভুয়া পরিচয়ে কোটি টাকার প্রতারণা, ডিবি তদন্তে দুই সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও সাংবাদিকের ভয়ঙ্কর জালিয়াতি ফাঁস

  প্রতিনিধি ১০ অগাস্ট ২০২৫ , ৮:১১ এএম প্রিন্ট সংস্করণ

ভুয়া পরিচয়ে কোটি টাকার প্রতারণা

ভয়ংকর প্রতারণার জালে জড়িয়েছেন সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত দুই সাবেক কর্মকর্তা ও এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক। গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি) পুলিশের তদন্তে তাদের ভয়াবহ জালিয়াতির চিত্র সামনে এসেছে। কখনো নিজেদের গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের পরিচালক, আবার কখনো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কনসালট্যান্ট পরিচয় দিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সম্প্রতি স্বনামধন্য সৌরবিদ্যুৎ উদ্ভাবক প্রকৌশলী শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরীর অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে এই প্রতারক চক্রের আসল রূপ উন্মোচিত হয়েছে।

২০১৪ সালে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হন শেখ আবু মেহেদী ও সরদার আমান উল্লাহ। এরপর থেকেই তারা নানা ধরনের প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত হন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন গিয়াস উদ্দিন নামের এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক। গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর তারা নতুন করে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। প্রকৌশলী শাহরিয়ার চৌধুরীর অভিযোগ অনুযায়ী, সাবেক মেজর শেখ আবু মেহেদী, সরদার আমান উল্লাহ এবং সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন যৌথবাহিনী দিয়ে তাকে গ্রেপ্তারের ভয় দেখান। গত বছরের ১৪ আগস্ট আমান উল্লাহ নিজেকে এনএসআই কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে শাহরিয়ারের কাছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ক প্রকল্পের তথ্য চান। এরপর গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে তারা প্রথমে শাহরিয়ারের কাছ থেকে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন এবং পরে এক কোটি ৮০ লাখ টাকার চেক নিয়ে যান।

প্রকৌশলী শাহরিয়ার চৌধুরী এই জালিয়াতির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন। আদালত অভিযোগটি আমলে নিয়ে ডিবি পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। ডিবি পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে তদন্ত করে এই চক্রের ভয়ঙ্কর প্রতারণার প্রমাণ পেয়েছে। হুমকি দেওয়ার অডিও রেকর্ডিংসহ চেক নেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সব আলামত উদ্ধার করা হয়েছে।

ডিবি পুলিশের তেজগাঁও জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) রাকিব খান জানান, অভিযুক্ত সাবেক মেজর শেখ আবু মেহেদী, সরদার আমান উল্লাহ এবং গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১০৯, ১৭০, ৩৮৭, ৪২০ ও ৫০৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। ডিবি গত ২৯ জুলাই ১৭ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে দাখিল করেছে।

আদালতে দাখিল করা নথিপত্রে সাতজনের ১৬১ ধারার সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এদের মধ্যে শাওন সাহা নামের এক সাবেক সেনা কর্মকর্তা লিখিত জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, শেখ আবু মেহেদীর নির্দেশে তিনি প্রকৌশলী শাহরিয়ারের কাছ থেকে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। শাওন সাহা পুলিশকে জানান, গত ১৯ আগস্ট সন্ধ্যায় আবু মেহেদী তাকে গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। ধানমন্ডি ২৭-এর কফি ওয়ার্ল্ডে গিয়াস উদ্দিন তাকে শাহরিয়ার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করান। সেখানে শাহরিয়ারের গাড়ি থেকে তিনি ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা একটি ব্যাগে ভরে আবু মেহেদীর অফিসে পৌঁছান।

এই মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির এসআই মাজেদ আলীকে হুমকি দিয়ে ভয় দেখানোর অভিযোগও রয়েছে শেখ আবু মেহেদীর বিরুদ্ধে। ফলে পরবর্তীতে তদন্তের দায়িত্ব পান ইনস্পেকটর মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম।

জানা যায়, ডিবি শাওন সাহাকে আটক করার পর তিনি টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু ডিবির যুগ্মকমিশনার রবিউল ইসলামের নির্দেশে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে এই মামলা ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়ার জন্য প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ওঠে। তবে রবিউল ইসলাম এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে ছেড়ে দিতে বলিনি। বিবাদীদের বক্তব্য নেওয়ার জন্যই তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলেছিলাম।’

দুদকের একাধিক কর্মকর্তার সূত্রে জানা যায়, এই দুই সাবেক সেনা কর্মকর্তা দুদকের কনসালট্যান্ট পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করছেন, এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে দুদক থেকে সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়। ডিবি পুলিশের তদন্তেও এই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।

প্রতারণার শিকার হয়ে প্রকৌশলী শাহরিয়ার চৌধুরী গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর সরকারি কর্মকর্তার ছদ্মবেশ ধারণ, ভয়ভীতি, প্রতারণা, এবং চাঁদা দাবির অভিযোগে আদালতে একটি মামলা করেন। এই মামলায় শেখ আবু মেহেদী, সরদার আমান উল্লাহ এবং গিয়াস উদ্দিনকে আসামি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে শেখ আবু মেহেদী জানান, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো রাজনৈতিক। তিনি বলেন, ‘প্রকৌশলী শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, যা আমি ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করছিলাম। তখনই এই মামলা করা হয়েছে।’ তবে বাকি দুই অভিযুক্তের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।