খেলাধুলা

মাঠহীন শহর, ক্লাবহীন গ্রাম: হারিয়ে যাচ্ছে দেশের ক্রীড়া সংস্কৃতি

  প্রতিনিধি ১১ অগাস্ট ২০২৫ , ১০:৪৯ এএম প্রিন্ট সংস্করণ

মাঠহীন শহর, ক্লাবহীন গ্রাম: হারিয়ে যাচ্ছে দেশের ক্রীড়া সংস্কৃতি

একসময় বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, শহর, পাড়া-মহল্লায় খেলাধুলার এক প্রাণবন্ত সংস্কৃতি ছিল। গ্যালারি থাকত দর্শকে পরিপূর্ণ, ক্লাবগুলো ছিল খেলোয়াড়দের মিলনমেলা। আজ সেই ছবি প্রায় অতীত। জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা ও সাবেক ফুটবলার দেওয়ান নজরুল ওরফে কাবিলা কৌতুক করে বলেন, “দেশে যখন মানুষ ছিল সাড়ে সাত কোটি, তখন গ্যালারি থাকত পূর্ণ। এখন দেশে ২০ কোটি মানুষ অথচ দেশের অধিকাংশ স্টেডিয়ামের গ্যালারি থাকে শূন্য।” তার এই কথা যেন এক নির্মম বাস্তবতাকেই তুলে ধরে। নানা সংকটে জর্জরিত হয়ে দেশের ক্রীড়াঙ্গন আজ তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে।

খেলাধুলার এই সংকটের মূলে রয়েছে মাঠের অভাব। গ্রাম থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত সর্বত্রই খেলার মাঠের তীব্র সংকট। যে কয়েকটি খেলার মাঠ আছে, সেগুলোতেও নানা দখলদারিত্বের থাবা। কোথাও রিকশার গ্যারেজ, কোথাও রাজনৈতিক দলের অফিস তৈরি করে খেলার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি অনেক স্কুলেও খেলার মাঠ দূরে থাক, ইনডোর খেলাধুলারও সুযোগ নেই। এর পাশাপাশি প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব শিশু-কিশোরদের মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে ইলেকট্রনিক ডিভাইস নির্ভর করে তুলেছে।

একসময় দেশের আনাচে-কানাচে ক্লাবগুলো ছিল ক্রীড়া সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু এখন সামাজিক অবক্ষয়, আর্থিক সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেই ক্লাবগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সারা দেশে প্রায় পাঁচ হাজার ক্রীড়া ক্লাব বন্ধ হয়ে গেছে। জেলা পর্যায়ে নিয়মিত খেলাধুলা না হওয়ায় ক্লাবগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং খেলোয়াড়রা খেলা ছেড়ে মুদি দোকানদার কিংবা ভ্যানচালকের মতো ভিন্ন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

আবাহনী ও মোহামেডানের মতো ঐতিহ্যবাহী দলগুলোও তাদের পুরোনো জৌলুস হারিয়েছে। ‘ঐতিহ্য’ শব্দটি এখন শুধু কাগজে-কলমেই টিকে আছে। অন্যদিকে, বসুন্ধরা কিংস, ফর্টিজ, লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ, শাইনপুকুর ও গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের মতো নতুন দলগুলো উঠে এসে তাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে। একসময় ঢাকার মাঠ কাঁপানো ওয়ান্ডারার্স, দিলকুশা, ইস্ট এন্ড ক্লাব এবং আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের মতো জায়ান্ট কিলার দলগুলো এখন সাইনবোর্ডসর্বস্ব হয়ে কোনোভাবে টিকে আছে।

মতিঝিল ক্লাবপাড়ার দলগুলোর হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল জুয়ার আসক্তি। একটা সময় ছিল যখন সূর্য ডোবার পর ক্লাবগুলোতে রমরমা জুয়ার আসর বসতো। ধীরে ধীরে তা ২৪ ঘণ্টার ক্যাসিনো হাউজে পরিণত হয়। ২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর এসব বন্ধ হলেও ততদিনে খেলার পরিবেশ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। জুয়া থেকে সহজে টাকা আয়ের সুযোগ থাকায় খেলাধুলার চেয়ে জুয়াকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। এর পাশাপাশি, টাকার অভাবেও অনেক ঐতিহ্যবাহী ক্লাব বন্ধ হয়ে গেছে।

একই করুণ পরিণতি হয়েছে অফিসপাড়ার ক্লাবগুলোরও। বিজেএমসি, পিডব্লিউডি, ওয়াপদা, সাধারণ বীমা, রেলওয়ে, কাস্টমস, পোস্ট অফিস, চলন্তিকা ও বিআরটিসির মতো দলগুলো হারিয়ে গেছে। একটা সময় বিজেএমসি, ইপিআইডিসি এবং বিআইডিসি নামে বহুবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সেই দলে খেলেছেন মালা, টুলু, জাকারিয়া পিন্টু, শেখ মো. আসলাম এবং কায়সার হামিদদের মতো কিংবদন্তি খেলোয়াড়রা। কিন্তু কালের গর্ভে সেই গৌরব আজ বিলীন।

জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার হাসানুজ্জামান খান বাবলুর মতে, “একটা সময় পাড়া-মহল্লায় অলিগলিতে ক্লাব ছিল। ক্লাবকে কেন্দ্র করে খেলাধুলার পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এখন খেলাধুলাই নেই। ক্লাবগুলো তাদের অস্তিত্ব হারিয়েছে।” তার এই কথাগুলোই যেন দেশের ক্রীড়া সংস্কৃতির বর্তমান অবস্থার করুণ চিত্র। মাঠের অভাব, ক্লাবের পতন এবং নানা সামাজিক সংকটের কারণে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন আজ এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে দেশের ক্রীড়া সংস্কৃতি হয়তো চিরতরে হারিয়ে যাবে।