প্রতিনিধি ১৫ অগাস্ট ২০২৫ , ১:৫৯ পিএম প্রিন্ট সংস্করণ
গত এক মাসের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় বাজারে আবারও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। পেঁয়াজ, ডাল, আটা, ডিম, মুরগি এবং বিভিন্ন সবজির দাম ৫০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ ক্রেতারা চরম বিপাকে পড়েছেন। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের এই ভারসাম্যহীনতায় হিমশিম খাচ্ছেন সীমিত আয়ের মানুষ। সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য এবং রাজধানীর খুচরা বাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত এক মাসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বেড়েছে।
নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি
বর্তমানে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে পেঁয়াজের। প্রতি কেজিতে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ দাম বেড়ে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। একইভাবে খোলা আটা প্রতি কেজিতে ১২ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়। ডিমের দামও আকাশ ছুঁয়েছে, প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়ে এখন ১৫০ টাকায় পৌঁছেছে। সোনালি মুরগির দাম ৭ থেকে ১০ শতাংশ বেড়ে ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মসুর ডালের দামও বেড়েছে, দেশি মসুর ডাল কেজিতে ১১ থেকে ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা।
মাছের বাজারেও একই চিত্র। মাঝারি আকারের রুই মাছের দাম এক মাসে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ বেড়ে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি হয়েছে। সবজির বাজারে আলু ও পেঁপে ছাড়া সবকিছুর দাম চড়া। বেগুনের দাম ২৫ থেকে ৩৩ শতাংশ বেড়ে মানভেদে ১০০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি। কোনো কোনো বাজারে গোল বেগুন ১৮০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হচ্ছে। টমেটোর মৌসুম না হওয়ায় এর দামও আকাশচুম্বী, প্রতি কেজিতে ১৪ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়ে ১৬০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বগুড়ার মতো উত্তরাঞ্চলের সবজি বাজারেও অতিবৃষ্টির কারণে সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে।
কেন এই অস্থিরতা?
বাজার বিশ্লেষক এবং অর্থনীতিবিদরা এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৭.৫৬ শতাংশ, যা জুন মাসে ছিল ৭.৩৯ শতাংশ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ায় চলতি মাসে এই মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারে কার্যকর তদারকির অভাব, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি এবং কৃত্রিম সংকট তৈরি মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়াও, বিশ্ব বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি, ডলার সংকট এবং সরবরাহ চেইনের সমস্যাও এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করা সংস্থা ‘ভোক্তা’র নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল বলেন, “দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, আমদানিনির্ভরতা, ডলার সংকট, সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত এবং অদক্ষ বাজার নিয়ন্ত্রণ সব মিলিয়ে এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।”
সরকারের পদক্ষেপ এবং প্রত্যাশা
এই পরিস্থিতিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন জানিয়েছেন, বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়াতে আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে। শুধু ভারত থেকে নয়, ব্যবসায়ীরা যেখান থেকে কম দামে আমদানি করতে চাইবেন, সেখান থেকেই অনুমতি মিলবে। তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো পেঁয়াজের দাম কমানো এবং সরবরাহ নিশ্চিত করা।
তবে, অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, শুধু নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের উপর নজরদারি না করে সামগ্রিক বাজার নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। বাজার তদারকি জোরদার করা, অসাধু মজুদদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির উপর জোর দিতে হবে। বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ও সহায়তা পৌঁছে দিতে পারলে আমদানিনির্ভরতা কমে আসবে। এর পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো আরও বিস্তৃত করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা, যাতে স্বল্প আয়ের মানুষ স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহ কর্মসূচির আওতায় পর্যাপ্ত সহায়তা পায়। এই ধরনের বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে দ্রব্যমূল্যের চাপ অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি ফিরে আসবে।