খেলাধুলা

দ্য রেজিং বুল: সিনেমার রূপালী পর্দায় এক উন্মত্ত ষাঁড়ের গল্প

  প্রতিনিধি ২০ অগাস্ট ২০২৫ , ১০:৫৬ এএম প্রিন্ট সংস্করণ

দ্য রেজিং বুল: সিনেমার রূপালী পর্দায় এক উন্মত্ত ষাঁড়ের গল্প

মার্টিন স্করসিস এবং রবার্ট ডি নিরো—এই দুই কিংবদন্তির নাম একসাথে এলেই সিনেমার রূপালী পর্দায় জন্ম নেয় নতুন ইতিহাস। তাঁদের সেরা কাজ কোনটি, তা নিয়ে হয়তো বিস্তর তর্ক হতে পারে। তবে অনেক সমালোচক ও সিনেমাপ্রেমীর মতে, সেই তর্কের চূড়ান্ত উত্তর হলো ‘রেজিং বুল’। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সিনেমা রিভিউ সাইট রটেন টমেটোজ এই সিনেমাকে বর্ণনা করেছে “কষ্টকর, কিন্তু সহানুভূতিহীন এক নায়কের তীব্র আর শক্তিশালী কাহিনি” হিসেবে। কিন্তু কেন?

আসলে, ‘রেজিং বুল’ কেবল বক্সিংয়ের গল্প নয়, এটি মানুষের ভেতরের জমে থাকা ক্রোধ, সন্দেহ, এবং হিংস্রতার এক নিবিড় রূপায়ণ। এটি সেই উন্মত্ততার গল্প যা মানুষকে সাফল্যের চূড়া থেকে টেনে নামায় মাটিতে। ১৯৪০-এর দশকের মিডলওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন জেক লামোত্তার আত্মজীবনী ‘রেজিং বুল: মাই স্টোরি’ অবলম্বনে এই সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন প্রবাদপ্রতিম পরিচালক মার্টিন স্করসিস। লামোত্তার চরিত্রে অভিনয় করে রবার্ট ডি নিরো শুধু অস্কার জিতে নেননি, বরং নিজের অভিনয় ক্ষমতার এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

দুই ঘণ্টার এই সিনেমাটি যত এগোয়, ততই স্পষ্ট হয় যে এটি একজন বক্সারের ব্যক্তিগত জীবনের অস্থিরতা, সন্দেহ, আর রাগ কীভাবে তাঁর খেলা এবং সম্পর্ককে প্রভাবিত করে তার প্রতিচ্ছবি। সিনেমার একটি দৃশ্যে, জেকের স্ত্রী ভিকি তাঁর এক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ‘সুন্দর’ বলার পর, জেক রিংয়ে সেই প্রতিদ্বন্দ্বীকে এমনভাবে আঘাত করেন যে তার মুখ একেবারে বিকৃত হয়ে যায়। লড়াই শেষে জেকের ঠান্ডা মন্তব্য—”এখন আর সুন্দর নেই”—শুধুমাত্র একটি বাক্য নয়, এটি জেকের ভেতরের হিংস্রতা ও সন্দেহের এক ভয়ংকর বহিঃপ্রকাশ।

সিনেমাটি নির্মাণে খরচ হয়েছিল ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। বক্সিং রিংয়ের দৃশ্যগুলো রক্ত আর সহিংসতায় পূর্ণ, যা অনেক দর্শকের কাছে বিরক্তিকর মনে হতে পারে। তবে পরিচালক মার্টিন স্করসিস ইচ্ছাকৃতভাবে এই “খেপা ষাঁড়” ভাবটি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি ইতালীয় পরিচালক লুচ্চিনো ভিসকোন্তির ‘রোকো অ্যান্ড হিজ ব্রাদার্স’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

‘রেজিং বুল’ কেবল এর গল্পের জন্যই নয়, বরং এর অসাধারণ সম্পাদনা ও সাউন্ড মিক্সিংয়ের জন্যও অনন্য। স্করসিস এই দিকগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন, কারণ তখন তাঁর মনে হয়েছিল এটিই হয়তো তাঁর জীবনের শেষ সিনেমা। যদিও আজ আমরা জানি, সেই ধারণা ভুল ছিল। সিনেমাটি অস্কারের আটটি বিভাগে মনোনয়ন পায় এবং ‘বেস্ট এডিটিং’ পুরস্কার জিতে নেয়।

এই কালজয়ী সিনেমাটি নির্মাণের পেছনের গল্পটাও বেশ চমকপ্রদ। একবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি স্করসিসের হাতে বইটি তুলে দিয়ে রবার্ট ডি নিরো বলেছিলেন, “আমাদের এটা বানানো উচিত।” এরপরই সিনেমার কাজ শুরু হয়। তবে শুরুতে ‘রেজিং বুল’ আদৌ মুক্তি পাবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। স্করসিস নিজেও বলেছিলেন, “মনে হচ্ছিল, এটা শুধু নিজেদের জন্য বানাচ্ছি।” কিন্তু সমালোচক রজার এবার্ট পরে লিখেছিলেন যে, এই সিনেমার মাধ্যমে স্করসিস যেন নতুনভাবে জন্ম নিয়েছিলেন।

প্রথম দিকে বক্স অফিসে তেমন সাফল্য না পেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি এক ‘কাল্ট ক্লাসিক’-এর মর্যাদা লাভ করে। অনেকেই এর রক্তাক্ত দৃশ্যের সমালোচনা করলেও, এখন এটি খেলাধুলা বা জীবনভিত্তিক সিনেমার তালিকায় অন্যতম সেরা হিসেবে বিবেচিত। ১৯৯০ সালে যখন লাইব্রেরি অব কংগ্রেস ‘সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক ও সৌন্দর্যগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ’ সিনেমাগুলো সংরক্ষণ করা শুরু করে, তখন ন্যাশনাল ফিল্ম রেজিস্ট্রির প্রথম নামই ছিল ‘রেজিং বুল’।

‘রেজিং বুল’ শুধুমাত্র একটি সিনেমা নয়, এটি মানব মনের অন্ধকার দিক এবং তার পরিণতি সম্পর্কে এক গভীর পর্যবেক্ষণ। পরিচালক মার্টিন স্করসিস, অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো এবং পুরো টিমের অসাধারণ প্রচেষ্টায় এটি এমন একটি সিনেমা যা আজও দর্শকদের মনে গেঁথে আছে।

রেজিং বুল (১৯৮০)

  • পরিচালক: মার্টিন স্করসিস
  • চিত্রনাট্য: পল শ্রেরডের ও মার্দিক মার্টিন
  • অভিনয়: রবার্ট ডি নিরো, জো পেস্কি, ক্যাথি মরিয়ার্টি, ফ্যাঙ্ক ভিনসেন্ট
  • আইএমডিবি রেটিং: ৮.১/১০
  • রানটাইম: ২ ঘণ্টা ৯ মিনিট