উপদেষ্টা পরিষদের নতুন সিদ্ধান্ত: আড়িপাতার যন্ত্র কেনা তদন্তে কমিটি, ২৪৬ সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে জোর
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বৈঠকের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। এই ব্রিফিংয়ে উঠে আসে বিভিন্ন স্পর্শকাতর ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার মধ্যে রয়েছে আড়িপাতার যন্ত্র কেনা নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন, শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা, এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন।
আড়িপাতার যন্ত্র কেনার তদন্তে কমিটি
সংবাদ ব্রিফিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা ছিল আড়িপাতার যন্ত্র কেনা সংক্রান্ত একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত। প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, বিগত সরকার ইসরায়েল থেকে বিপুল পরিমাণ আড়িপাতার যন্ত্র কিনেছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, “সারভেইলেন্সের যন্ত্রপাতি বিগত সরকারের সময়—কেউ বলছেন প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারে কেনা হয়েছে, কেউ বলছেন প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারে এগুলো করা হয়েছে।” এই যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বাংলাদেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও বাক্স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। শফিকুল আলম স্পষ্ট করে বলেন, “এই অবৈধ নজরদারি করার জন্য আমার-আপনার ন্যূনতম বাক্স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।” তিনি আরও জানান, পুলিশের জন্য মারণাস্ত্র কেনা নিয়েও একটি তদন্ত চলছে।
শ্রমিকদের হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার এবং মালয়েশিয়া সফর
সংবাদ ব্রিফিংয়ে শ্রমিক অধিকার সুরক্ষার বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রেস সচিব জানান, বিগত সরকারের আমলে শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে করা ৯০ শতাংশ হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই পদক্ষেপকে বাংলাদেশের লেবার অ্যাক্টিভিজমকে দমন করার প্রচেষ্টা থেকে সরে আসার একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে তুলে ধরা হয়।
এছাড়াও, প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক মালয়েশিয়া সফরকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ ও ‘ল্যান্ডমার্ক ট্যুর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই সফরের ফলে মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা এখন থেকে মালয়েশিয়ার নাগরিকদের মতোই সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা পাবেন। শ্রমিকদের অভিযোগ জানানোর জন্য বাংলা ভাষায় অভিযোগ দাখিলের সুযোগ, অবৈধ শ্রমিকদের বৈধকরণের উদ্যোগ, এবং বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ‘গ্র্যাজুয়েট প্লাস’ প্রোগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
২৪৬টি নতুন সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত
বৈঠকে আরও ২৪৬টি নতুন সংস্কার প্রস্তাব ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে শ্রম সংস্কার বিষয়ক ৮২টি, নারী বিষয়ক ৭১টি, স্থানীয় সরকার বিষয়ক ৩৭টি, স্বাস্থ্য বিষয়ক ৩৩টি, এবং তথ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক ২৩টি সুপারিশ রয়েছে। প্রেস সচিব জানান, এ নিয়ে মোট ৩৬৭টি সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য চিহ্নিত করা হলো, যার মধ্যে ৩৭টি ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা জোর দিয়েছেন।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত
সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মী পুনরেকত্রীকরণ নীতি, ২০২৫’ অনুমোদন করা হয়েছে। এই নীতির উদ্দেশ্য হলো বিদেশ ফেরত কর্মীদের জ্ঞান ও দক্ষতার স্বীকৃতি দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, তাদের উদ্যোক্তা হতে সহায়তা করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এছাড়াও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন সংশোধনের বিষয়টিও আলোচনায় আসে। এই নতুন আইনটির খসড়া শিগগিরই উপদেষ্টা পরিষদের কাছে আসবে বলে জানানো হয়।
সব মিলিয়ে, উপদেষ্টা পরিষদের এই বৈঠকটি জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পথে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের নাগরিক অধিকার রক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা যায়।