দীর্ঘ ছয় বছর পর ডাকসু নির্বাচন: জমে উঠেছে ক্যাম্পাস রাজনীতি, ছাত্রদল নীরব, নতুন প্যানেলে আগ্রহ

দীর্ঘ ছয় বছর পর আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনকে ঘিরে ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন তাদের প্যানেল গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছে। তবে, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের তৎপরতা তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা জল্পনা। অন্যদিকে, নতুন সংগঠনগুলোর সক্রিয়তা এবারের নির্বাচনকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।

ছাত্রদলের নীরবতা ও অভিযোগ ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ছাত্রদলের তৎপরতা কম হওয়ার কারণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে মব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন ব্যর্থ। ছাত্রলীগের অনেকে ভোটার তালিকায় রয়েছেন এবং জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া কয়েকজন শিক্ষক এখনো বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষক হিসেবে বহাল আছেন।’ তিনি আরও অভিযোগ করেন, ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা হলে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না এবং নির্বাচনের জন্য সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়নি। ছাত্রদলের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সংগঠন সরাসরি নিজেদের নামে প্যানেল দেবে কিনা, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে ভিপি ও জিএস পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান এবং কবি জসীমউদ্‌দীন হল শাখার আহ্বায়ক শেখ তানভীর বারী হামিমের নাম আলোচনায় আছে।

নতুন শক্তি হিসেবে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে নতুন ছাত্রসংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (ডিএসএস)। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশের উদ্যোগে গত ফেব্রুয়ারিতে এই সংগঠন গঠিত হয়। ডিএসএস নিজেদের নামে নয়, বরং শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে একটি ভিন্ন নামে প্যানেল ঘোষণা করবে। তাদের প্যানেলে সহসভাপতি (ভিপি) পদে আবদুল কাদের এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে আবু বাকের মজুমদারের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। আবু বাকের মজুমদার জানান, তাদের প্যানেলে এক-তৃতীয়াংশ নারী শিক্ষার্থী থাকবে, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।

শিবিরের ভিন্ন কৌশল দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য কার্যক্রম না থাকলেও গত বছরের ৫ আগস্টের পর ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের কমিটি প্রকাশ করে এবং নানা কর্মসূচির মাধ্যমে সক্রিয় হয়। আগামী সপ্তাহে তারা তাদের প্যানেল ঘোষণা করতে পারে। শিবিরও সরাসরি নিজেদের নামে নয়, অন্য কোনো নামে প্যানেল দেওয়ার কৌশল নিয়েছে। সম্ভাব্য ভিপি প্রার্থী হিসেবে সংগঠনের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক মো. আবু সাদিক কায়েম এবং জিএস হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদের নাম শোনা যাচ্ছে। সাদিক কায়েম জানান, তারা অন্যান্য দল ও সংগঠনের সঙ্গে জোট করার কথাও ভাবছেন।

ঐক্যবদ্ধভাবে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট এবারের নির্বাচনে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট নামে একটি যৌথ প্যানেল ঘোষণা করবে। এই জোটে ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলসহ মোট সাতটি সংগঠন রয়েছে। এই জোটের ভিপি পদে ছাত্র ইউনিয়নের মেঘমল্লার বসু এবং জিএস পদে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর জাবির আহমেদের (জুবেল) নাম আলোচনায় রয়েছে। জোটের নেতারা মনে করেন, এই নির্বাচন আগামী দিনের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তারা পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদেরও তাদের প্যানেলে যুক্ত করার চেষ্টা করছেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও মাঠে দলীয় প্যানেলের বাইরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা একটি স্বতন্ত্র প্যানেল নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। একসময় ছাত্র ফেডারেশনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তিনি বামপন্থী জোটের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুতই তার প্যানেল ঘোষণা করবেন।

ডাকসু নির্বাচনের নতুন দিক এবার ডাকসু নির্বাচনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে স্থাপন করা। প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনের মতে, এটি একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, যা ভোটারদের ওপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ কমাবে এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবে। গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে মনোনয়নপত্র বিতরণ, যা চলবে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত। ১৯ আগস্ট মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর ২১ আগস্ট চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে। এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৭৭৫ জন।

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা এখন নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ আবহের জন্য অপেক্ষা করছেন, যেখানে প্রার্থীরা তাদের প্যানেল চূড়ান্ত করে পুরোদমে প্রচার শুরু করবেন। এই নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।