পুঁজিবাজারে নতুন নিয়ম: মার্জিন ঋণ নিতে বিনিয়োগকারীর অভিজ্ঞতা ও ন্যূনতম মূলধন বাধ্যতামূলক!

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সম্প্রতি তারা মার্জিন ঋণ নীতিমালা-২০২৫ এর একটি খসড়া প্রকাশ করেছে, যেখানে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে বিনিয়োগকারীর অভিজ্ঞতা, ন্যূনতম নিজস্ব বিনিয়োগ এবং একটি নির্দিষ্ট আয় থাকার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে ২০১০ সালের মতো বড় ধরনের ধসের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

 

মার্জিন ঋণ পেতে নতুন শর্ত

 

খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো বিনিয়োগকারী যদি মার্জিন ঋণ নিতে চান, তবে তাকে বেশ কিছু নতুন শর্ত পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে প্রধান শর্ত হলো, তার নিজস্ব বিনিয়োগের পরিমাণ কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা হতে হবে। একই সাথে, পুঁজিবাজারে তার বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা কমপক্ষে এক বছর হওয়া আবশ্যক। এর বাইরে, যাদের কোনো নিয়মিত আয় নেই, তারাও এই ধরনের ঋণ নিতে পারবেন না।

ঋণের পরিমাণ নির্ধারণেও নতুন নিয়ম প্রস্তাব করা হয়েছে। যদি কোনো বিনিয়োগকারীর নিজস্ব বিনিয়োগ ৫ লাখ টাকার বেশি কিন্তু ১০ লাখ টাকার কম হয়, তবে তিনি তার বিনিয়োগের সর্বোচ্চ অর্ধেক পরিমাণ ঋণ নিতে পারবেন। অন্যদিকে, যদি নিজস্ব বিনিয়োগ ১০ লাখ টাকার বেশি হয়, তবে তিনি তার বিনিয়োগের সমপরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে নিতে পারবেন। তবে, একটি প্রতিষ্ঠান কোনো অবস্থাতেই তাদের নিজস্ব মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি বা ১০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দিতে পারবে না। এই নিয়মের ফলে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকবে, যা সামগ্রিক ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।

 

বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা: বাধ্যতামূলক মূলধন ফেরত

 

২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধসের পর লাখ লাখ বিনিয়োগকারী তাদের সমস্ত পুঁজি হারিয়েছিলেন। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন নীতিমালায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান যুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, যদি কোনো বিনিয়োগকারীর লোকসান হয়, তবে তিনি তার কিছু না কিছু মূলধন ফেরত পাবেন। এটি একটি বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা, যা আগে ছিল না। এই নিয়ম কার্যকর হলে ভবিষ্যতে কোনো বড় দরপতনের সময় বিনিয়োগকারীরা পুরোপুরি নিঃস্ব হবেন না এবং তাদের পুঁজির একটি অংশ সুরক্ষিত থাকবে।

 

‘ফোর্স সেল’ ও প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা

 

নতুন খসড়ায় ‘ফোর্স সেল’ নিয়েও একটি স্পষ্ট বিধান রাখা হয়েছে। সাধারণত, মার্জিন অ্যাকাউন্টের পোর্টফোলিও মূল্য যদি ঋণের ১৫০ শতাংশের নিচে নেমে যায়, তাহলে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রাহককে (বিনিয়োগকারী) নোটিশ ছাড়াই শেয়ার বিক্রি করে ঋণ সমন্বয় করতে পারবে। এটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

যদি কোনো প্রতিষ্ঠান এই পরিস্থিতিতে অবহেলা করে শেয়ার বিক্রি না করে এবং এর ফলে বিনিয়োগকারীর আরও আর্থিক ক্ষতি হয়, তবে সেই ক্ষতির দায়ভার প্রতিষ্ঠানকেই বহন করতে হবে। তবে, পোর্টফোলিও মূল্য যখন ঋণের ১৭৫ শতাংশে নেমে আসবে, তখন ঋণ সমন্বয় করতে বিনিয়োগকারীকে সাত দিনের মধ্যে তিনটি নোটিশ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই নিয়মগুলো প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা বাড়াবে এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করবে।

 

পুরোনো বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন নির্দেশনা

 

এই নতুন নীতিমালা কার্যকর হওয়ার পর যেসব বিনিয়োগকারী বর্তমানে ৫ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মার্জিন ঋণ নিয়েছেন, তাদের জন্য এক বছরের সময় দেওয়া হবে। এই সময়ের মধ্যে তাদের নিজস্ব বিনিয়োগের পরিমাণ ৫ লাখ টাকায় উন্নীত করতে হবে। তা না হলে, সেই মার্জিন অ্যাকাউন্টের সব শেয়ার বিক্রি করে অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেওয়া হবে।

বিএসইসি তাদের ওয়েবসাইটে এই খসড়া নীতিমালাটি প্রকাশ করেছে এবং আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সকলের মতামত চেয়েছে। আগ্রহী ব্যক্তিরা ইমেইল বা সরাসরি বিএসইসির কার্যালয়ে মতামত পাঠাতে পারেন। সকলের মতামতের ভিত্তিতেই এই নতুন নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, যা বাজারকে আরও স্থিতিশীল এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ করবে।