মাঠের বাইরের জীবন: গাভাস্কারের চোখে একালের ক্রিকেটারদের অজানা গল্প
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সফরের বাইরের জীবনটা কেমন? খেলার চাপ, অনুশীলনের ক্লান্তি আর মাঠের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে ক্রিকেটারদের দৈনন্দিন জীবনটা কীভাবে কাটে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, বিদেশ সফর মানে শুধু ক্রিকেট নয়, বরং বিচিত্র অভিজ্ঞতা, অদ্ভুত সব ঘটনা আর চ্যালেঞ্জের এক প্যাকেজ। সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কার তাঁর আত্মজীবনী ‘সানি ডেজ’-এ সেই সময়ের ক্রিকেটারদের জীবনের এমন অনেক মজার আর অজানা অধ্যায় তুলে ধরেছেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০-এর দশকের সেই গল্পগুলো আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ মাঠের বাইরের অনেক চ্যালেঞ্জই আজও ক্রিকেটারদের জন্য কম-বেশি একই রকম।
একটি নতুন দেশে পা রাখার পর ক্রিকেটারদের প্রথম সমস্যা হলো সেখানকার ভাষা এবং সংস্কৃতিতে মানিয়ে নেওয়া। বিশেষ করে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ইংরেজি উচ্চারণ এতটাই ভিন্ন যে তা বোঝা ভারতীয় ক্রিকেটারদের জন্য কঠিন ছিল। খাবারও ছিল আরেক বড় চ্যালেঞ্জ। যেখানে দক্ষিণ ভারতীয় ক্রিকেটাররা ভাতের খোঁজে চাইনিজ রেস্তোরাঁয় ছুটতেন, সেখানে উত্তর ভারতীয়দের ভরসা ছিল চিলি সসের বোতল। তবে ইংল্যান্ডে ভারতীয় রেস্তোরাঁ এবং প্রবাসী পরিবারগুলোর উষ্ণ আতিথেয়তা এই সমস্যা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল। গাভাস্কারের লেখায় উঠে আসে নিউজিল্যান্ডের এক সফরের কথা, যেখানে ভারতীয় পরিবারগুলোর আপ্যায়নে মুগ্ধ হয়ে ক্রিকেটাররা একসময় সেখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবার চেখে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।
শুধু খাওয়া-দাওয়াই নয়, আবহাওয়া মানিয়ে নেওয়াও ছিল এক বড় পরীক্ষা। ভারতের উষ্ণ অঞ্চল থেকে আসা খেলোয়াড়দের জন্য ঠাণ্ডা আবহাওয়া রীতিমতো ভোগান্তির কারণ ছিল। গাভাস্কার লিখেছেন, চারটা সোয়েটার পরে ক্রিকেট খেলা কতটা কঠিন এবং কীভাবে এই ঠাণ্ডা হাতে বল এলে ক্যাচ মিস হওয়াটা স্বাভাবিক।
ক্রিকেটারদের জীবনের আর একটি বড় অংশ ছিল অবিরাম ভ্রমণ। এক ম্যাচ শেষ করে রাতে বাসে করে পরের গন্তব্যে রওনা দেওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটে খেলোয়াড়রা এতটাই ব্যস্ত থাকতেন যে অনেক সময় স্যুটকেস খোলারই সুযোগ পেতেন না। এই দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর বাস ভ্রমণগুলোতেই জন্ম নিত অনেক মজার স্মৃতি। খেলোয়াড়রা একে অন্যের সাক্ষাৎকার নিতেন, গান গাইতেন, আর তাস খেলায় মেতে উঠতেন।
গাভাস্কারের বর্ণনা থেকে জানা যায়, মুম্বাইয়ের ক্রিকেটাররা সফরকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতেন। তাঁদের ‘সানডে ক্লাব’ ছিল এক দারুণ উদ্যোগ, যেখানে সিনিয়র ও জুনিয়র খেলোয়াড়রা একসঙ্গে আড্ডা দিতেন, মজা করতেন। এই ক্লাবগুলো শুধু সখ্যতা বাড়াত না, বরং নতুন খেলোয়াড়দের নার্ভাসনেস কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করত। অস্ট্রেলিয়ার ‘রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ দলের এমনই এক মিটিংয়ের মজার ঘটনাও উঠে এসেছে তাঁর লেখায়, যেখানে ড্রেসকোড নিয়ে টনি গ্রেগের হাস্যকর যুক্তি সবাইকে হাসিয়েছিল।
মাঠের বাইরে ক্রিকেটারদের এমন অনেক মজার ঘটনার সাক্ষী ছিলেন গাভাস্কার। ম্যানেজারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গভীর রাতে পার্টি থেকে ফেরা, আবার ম্যানেজারদের লুকিয়ে থাকা দেখে তাঁদেরই চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা তাঁর লেখাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। গাভাস্কারের সময়ের ম্যানেজাররা ছিলেন স্কুল শিক্ষকের মতো কঠোর, কিন্তু আজকালকার ক্রিকেটাররা তুলনামূলকভাবে স্বাধীন। ক্রিকেট বোর্ডও এখন বুঝতে পেরেছে যে একজন খেলোয়াড় যদি নিজের সেরাটা দিতে চান, তাহলে তাঁকে মানসিকভাবে ফুরফুরে থাকাটা জরুরি।
বিদেশ সফরে প্রেমের ঘটনাও ছিল স্বাভাবিক। গাভাস্কার তাঁর আত্মজীবনীতে এক অদ্ভুত ঘটনার কথা লিখেছেন। গায়ানা সফরে এক স্থানীয় মেয়ে তাঁর কাছে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল, কেবল ভারতে যাওয়ার জন্য। গাভাস্কার যখন জানান যে তিনি বিবাহিত, তখন সেই মেয়ে তাঁকে বলেছিল, তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত বলে তাকেই বেছে নিয়েছিল।
১৯৭৬ সালে লেখা এই আত্মজীবনীতে গাভাস্কারের প্রতিটি গল্পই যেন জীবন্ত। ক্রিকেট মাঠে তাঁর কিংবদন্তি ব্যাটিং যেমন এক অধ্যায়, তেমনি মাঠের বাইরের এই অভিজ্ঞতাগুলোও তাঁর জীবনের এক ভিন্ন দিক তুলে ধরে। এই লেখাগুলো প্রমাণ করে, বিশ্বভ্রমণ করে ক্রিকেট খেলা যতটাই কঠিন, তার বাইরের জীবনটা ছিল তার চেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর আর বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরা।