রুশ তেল আমদানিতে ভারতের ‘মুনাফাবাজি’: ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক বৃদ্ধি, দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন
ভূমিকা:
ইউক্রেন যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে রাশিয়া থেকে সস্তায় অপরিশোধিত তেল কিনে বিশাল মুনাফা করছে ভারতের কিছু ধনী পরিবার এবং তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান—এমন বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি মন্ত্রী স্কট বেসেন্ট। তার এই মন্তব্য এমন এক সময়ে এলো, যখন রুশ তেল কেনার কারণে ভারতের ওপর ট্রাম্প প্রশাসন শুল্ক দ্বিগুণ করেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক নতুন করে এক টানাপোড়েনের মুখে পড়েছে। দুই দেশের মধ্যে নির্ধারিত বাণিজ্য বৈঠক আকস্মিকভাবে বাতিল হওয়ায় এই উত্তেজনা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
রুশ তেলে ভারতের বিপুল লাভ:
সিএনবিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রেজারি মন্ত্রী স্কট বেসেন্ট জানান, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে ভারত রাশিয়া থেকে ১ শতাংশেরও কম তেল আমদানি করত। বর্তমানে সেই পরিমাণ বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তার দাবি, এই বিশাল লেনদেনের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্থাগুলো আনুমানিক ১৬ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত মুনাফা করেছে। বেসেন্ট এই কর্মকাণ্ডকে ‘ভারতীয় আর্বিট্রেজ’ বা মধ্যস্বত্ব অর্জন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, “সস্তায় রুশ তেল কিনে তা আবার পণ্যের আকারে বিক্রি করার এই প্রবণতা যুদ্ধের সময় শুরু হয়েছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ:
রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণে ট্রাম্প প্রশাসন গত ৬ আগস্ট ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করেছে। ট্রাম্প বারবার অভিযোগ করে আসছেন যে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে ভারতের তেল কেনা মূলত ‘যুদ্ধে ইন্ধন জোগাচ্ছে’। এই পদক্ষেপের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক’ বলে মন্তব্য করেছে এবং জানিয়েছে যে তারা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে।
চীন ও ভারতের মধ্যে পার্থক্য:
স্কট বেসেন্ট বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার কাছ থেকে চীনের তেল কেনা ১৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৬ শতাংশ হয়েছে, যা ভারতের তুলনায় অনেক কম। তিনি আরও বলেন, চীন অনেক আগে থেকেই রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছিল, কিন্তু ভারত যুদ্ধের সময় একটি ‘আর্বিট্রেজ সিস্টেম’ তৈরি করেছে, যা সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এর পেছনের উদ্দেশ্য কেবল মুনাফা। এই মন্তব্য ভারতের দিকে সরাসরি অভিযোগের আঙুল তুলেছে।
‘বিগ অয়েল লবি’র লোভ:
মার্কিন বাণিজ্য উপদেষ্টা এবং অর্থনীতিবিদ পিটার নাভারো তার এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে অভিযোগ করেছেন যে, ভারতের রুশ তেল আমদানি বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো ‘ভারতের বিগ অয়েল লবির মুনাফাবাজির লোভ’। এটি কোনোভাবেই দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা নয়। তার এই মন্তব্য ট্রেজারি মন্ত্রীর অভিযোগকে আরও জোরদার করেছে।
বৈঠক বাতিল এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্ক:
এই উত্তেজনার মধ্যেই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আসন্ন বাণিজ্য বৈঠক আকস্মিকভাবে বাতিল করা হয়েছে। গত মাসে দুই দেশের মধ্যে পঞ্চম দফার আলোচনা হলেও, ২৫ আগস্ট নয়াদিল্লিতে নির্ধারিত পরবর্তী বৈঠকটি বাতিল করা হয়। এই বাতিল হওয়া বৈঠক দুই দেশের মধ্যে বাড়তে থাকা অবিশ্বাস ও চাপা উত্তেজনারই ইঙ্গিত দেয়।
উপসংহার:
রুশ তেল আমদানি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই কঠোর অবস্থান এবং ভারতের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ককে এক নতুন সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ভারত তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষার কথা বললেও, যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের তীব্রতা দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্কে একটি বড় ফাটল তৈরি করেছে। এই সংকটের সমাধান কী হবে এবং দুই দেশের সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নেবে, তা সময়ই বলে দেবে।