৪০ পুলিশ কর্মকর্তার পদক প্রত্যাহার: নতুন সরকারে চলমান শুদ্ধি অভিযান

বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীতে এক বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম এবং অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকারসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার মোট ৪০ জন পুলিশ কর্মকর্তার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) এবং রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যা পলাতক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানকে তুলে ধরে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনটিতে ৭ আগস্ট তারিখ উল্লেখ থাকলেও বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে গত রোববার। এই প্রজ্ঞাপনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, “নিজ কর্মস্থল হতে পলায়ন করায় বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান থাকা ৪০ জন পুলিশ সদস্যের অনুকূলে প্রদত্ত পুলিশ পদক প্রত্যাহার করা হলো।” এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শুধু পদক প্রত্যাহার নয়, বরং আরও কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই কর্মকর্তারা গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে পলাতক রয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে কর্মস্থল থেকে অনুপস্থিত থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পদক প্রত্যাহারকৃত কর্মকর্তাদের তালিকায় ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা রয়েছেন। এটি প্রমাণ করে যে, উচ্চপদস্থ থেকে শুরু করে মধ্যম সারির কর্মকর্তারাও এই শুদ্ধি অভিযানের বাইরে নন।

এই ঘটনা বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের আমলে পুলিশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ছিল। বিশেষ করে, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কিছু পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দমন-পীড়ন এবং জনগণের ওপর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ ছিল। এই কর্মকর্তারা হয়তো সেই সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যার কারণে সরকারের পতনের পর তারা আত্মগোপনে চলে যান।

নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে। বিশেষ করে, সরকারি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে দায়িত্ব পালনের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। এই ৪০ জন পুলিশ কর্মকর্তার পদক প্রত্যাহার তারই একটি অংশ। এটি একটি বার্তা দেয় যে, আইনের চোখে সবাই সমান এবং কেউ জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়।

তবে, এই সিদ্ধান্তের কারণে পুলিশ বাহিনীর মনোবল কতটা প্রভাবিত হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এই ধরনের কঠোর পদক্ষেপ বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং পেশাদারিত্ব বাড়াতে সাহায্য করবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, এটি পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের ভয় ও অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। তবে, জনগণের মধ্যে এই পদক্ষেপ এক ধরনের স্বস্তি এনেছে। সাধারণ মানুষ মনে করছে, এবার অন্তত ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের বিচার হবে।

সামগ্রিকভাবে, এই ৪০ জন পুলিশ কর্মকর্তার পদক প্রত্যাহার বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, নতুন সরকার একটি স্বাধীন এবং জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে বদ্ধপরিকর। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং জনগণের আস্থা ফিরে আসবে, এমনটাই প্রত্যাশা করা হচ্ছে।