সাইবার ঝুঁকির মুখে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত: জনগণের ডেটা কতটা নিরাপদ?
বাংলাদেশে নির্বাচনের ঠিক আগে ব্যাংকিং খাতে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি ঢাকার একটি সেমিনারে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এই উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। তারা জানান, দেশের বেশিরভাগ ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। মাত্র ১৭-২০টি ব্যাংক সাইবার স্পেস রেটিংয়ে সন্তোষজনক অবস্থানে আছে। এছাড়া, জনগণের ব্যক্তিগত তথ্য প্রায়শই অনিরাপদ থাকে এবং কিছু ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সাইবার অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে।
মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) হোটেল সোনারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত ‘সাইবার ইন ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর অব বাংলাদেশ: সিকিউরিটি ইন ডিজিটাল ফিউচার’ শীর্ষক সেমিনারে এই চিত্র উঠে আসে। সেমিনারের আয়োজন করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি (এনসিএসএ) এবং ইডিজিই প্রকল্প।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ব্যাংকিং খাতের বর্তমান ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে আর্থিক অপরাধ, অনলাইন জুয়া, সফটওয়্যার আপডেটের অভাব এবং দুর্বল ফাইল ট্রান্সফার প্রটোকল। এছাড়া, ডিডস আক্রমণ এবং ডেটা সেন্টারের নিরাপত্তা ঝুঁকিও বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে, তাই এই খাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। দেশের জনগণের ডেটা সুরক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। জনগণের মধ্যে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে কর্মীদের জন্য সাইবার নিরাপত্তা প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ব্যাংকের আইটি এবং ব্যবসায়িক ইউনিটের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো গেলে সাইবার ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ব্যাংকের ডেটা ব্যবহারের মাধ্যমে কর আদায় প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করা যায়। এতে একদিকে যেমন সরকারের রাজস্ব বাড়বে, তেমনি কর ফাঁকিও কমবে। তবে ডেটা বিনিময়ের ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)-এর প্রধান মো. ছিবগাত উল্লাহ সেমিনারে জানান, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৮৮৪টি সাইবার অপরাধের অভিযোগ এসেছে। তিনি আরও বলেন, অনেক সময় ব্যাংকগুলো সাইবার অপরাধের বিষয়ে মামলা করতে চায় না, যা তদন্ত প্রক্রিয়ায় বড় বাধা তৈরি করে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্র্যাক ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক এবং সিটি ব্যাংকের মতো বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিরা প্রযুক্তিগত জটিলতা সমাধানের বিভিন্ন উপায় তুলে ধরেন। তারা বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু ডিজিটাল ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্যই নয়, বরং জনগণের আস্থা এবং আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্যও জরুরি।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী এনডিসি-এর সভাপতিত্বে এই সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে আইসিটি বিভাগের বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার প্রধানসহ আর্থিক খাতের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনরা উপস্থিত ছিলেন।
সার্বিক আলোচনায় এটি স্পষ্ট হয় যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে একটি শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব, কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি।