জাতীয়

প্রশাসনের লাগামহীন বিশৃঙ্খলা: অতিরিক্ত কর্মকর্তা থাকার পরও একই ব্যক্তিকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব!

  প্রতিনিধি ১২ অগাস্ট ২০২৫ , ৯:৩৯ এএম প্রিন্ট সংস্করণ

প্রশাসনের লাগামহীন বিশৃঙ্খলা: অতিরিক্ত কর্মকর্তা থাকার পরও একই ব্যক্তিকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব!

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রশাসনে এক চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, যা জনসেবা ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নকে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অনুমোদিত পদের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি কর্মকর্তা থাকলেও, একই ব্যক্তিকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, যার ফলে কাজ ব্যাহত হচ্ছে এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই পরিস্থিতির জন্য যোগ্য কর্মকর্তার অভাবকে দায়ী করলেও, বিশেষজ্ঞদের মতে এটি মূলত প্রশাসনিক ব্যর্থতা।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জনপ্রশাসনে প্রায় ১,৫০০ প্রকল্প চলমান রয়েছে, যার মধ্যে ১,১০০টিরও বেশি প্রকল্পের ব্যয় ৫০ কোটি টাকার বেশি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী, এই ধরনের বড় প্রকল্পের জন্য একজন পূর্ণকালীন ও অভিজ্ঞ প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগ করা বাধ্যতামূলক। একজন কর্মকর্তাকে একাধিক প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই নিয়মকে উপেক্ষা করে অনেক কর্মকর্তাকেই একাধিক বড় প্রকল্পের পিডির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে এবং ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।

উদাহরণস্বরূপ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ২১৩ কোটি টাকার জামালপুর জেলা কারাগার পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের পিডি উপসচিব সুব্রত কুমার রায়-কে ২৫০ কোটি টাকার ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগার সম্প্রসারণ প্রকল্পের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একইভাবে, ৩২৭ কোটি টাকার নরসিংদী জেলা কারাগার নির্মাণ প্রকল্পের পিডি মোকতার আহমদ চৌধুরী-কে ৬১০ কোটি টাকার কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার পুনর্নির্মাণ প্রকল্পেরও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের বহু নজির রয়েছে, যেখানে একজন কর্মকর্তাকে ৮-১০টি প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পিডি সুব্রত কুমার রায়ের মতে, একটি প্রকল্পের দায়িত্বই সঠিকভাবে পালন করতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে একাধিক দায়িত্ব পেলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক।

একদিকে যখন এমন পরিস্থিতি, তখন অন্যদিকে প্রশাসনে অনুমোদিত পদের চেয়ে প্রায় ২,৮৩৯ জন বেশি কর্মকর্তা কর্মরত আছেন। বিশেষ করে যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে অনুমোদিত পদের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি কর্মকর্তা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তিতে রয়েছেন। বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পদ ছাড়াই সংযুক্তিতে আছেন ২৮২ জন অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব। এ ছাড়া প্রায় দেড়শ কর্মকর্তা ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হয়ে আছেন।

প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া এই পরিস্থিতিকে ‘চরম বিশৃঙ্খলা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে, শীর্ষ আমলাদের প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণেই এমনটা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এই বিশৃঙ্খলা দূর করতে হলে বিধি-বিধান কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং পছন্দ-অপছন্দ নয়, বরং যোগ্যতা ও দক্ষতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।

অনেক কর্মকর্তার মধ্যে প্রকল্পের পিডি হওয়ার চেয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তিতে থাকার আগ্রহ বেশি। কারণ প্রকল্পের দায়িত্বে থাকলে অনেক পরিশ্রম করতে হয় এবং বাইরে কাজ করতে হয়, যা অনেক কর্মকর্তা পছন্দ করেন না। তবে, বিদেশি বিনিয়োগ আছে এমন প্রকল্পের পিডি হতে বা বিদেশ ভ্রমনের সুযোগ থাকলে সেই দায়িত্ব নিতে অনেক কর্মকর্তার আগ্রহ দেখা যায়। এই মানসিকতা প্রশাসনিক শৃঙ্খলা নষ্ট করছে এবং জনসেবাকে ব্যাহত করছে।

সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে এই প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন নিয়ে নানা ধরনের নির্দেশনা আসছে, যার ফলে জটিলতা আরও বাড়ছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ এবং নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা অপরিহার্য। অন্যথায়, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে এবং প্রশাসনিক কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।